বীরউত্তম এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদের মৃত্যু

admin
  • আপডেট টাইম : আগস্ট ১৬ ২০২৩, ১৯:০৮
  • 567 বার পঠিত
বীরউত্তম এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদের মৃত্যু

মোহাম্মদ জুনেদ আহমদ : বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান, মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্রভাগে নেতৃত্বদানকারী, বীরউত্তম এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ আমাদের ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বাংলাদেশের স্থানীয় সময় সোমবার ১৪ আগস্ট রাত ৮: ৪০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৭১এ দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কিলো-ফ্লাইট গঠন করে পাকিস্তানি মিলিটারির উপর বিমান হামলাকারী জাতির এই সূর্য সন্তান।

যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কঠিন দিনগুলোর প্রথমদিকে দুই নম্বর সেক্টর ও পরবর্তীকালে সেক্টর এক-এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সেই সময়ের স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদের মৃত্যুতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক জানিয়েছেন ও সশ্রদ্ধচিত্তে তার অবদান জাতি আজীবন স্মরণ রাখবে বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও প্রেস উইংয়ের মাধ্যমে পাঠানো এক শোকবার্তায়
মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস‍্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।

সুলতান মাহমুদ ১৯৬২’র ১ জুলাই বিমান বাহিনীর জিডি পাইলট হিসেবে সেসময়ের পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশন লাভ করেন।

১৯৭১ সালে সুলতান মাহমুদ পাকিস্তান বিমানবাহিনীর মৌরীপুর বিমানঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। এর অবস্থান ছিলো করাচিতে। তখন তার পদবি ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে তিনি মে মাসে সেখান থেকে পালিয়ে শ্রীলঙ্কা হয়ে ঢাকায় চলে আসতে সক্ষম হম। ঢাকা থেকে ভারতে যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে আটকের চেষ্টায় তাড়া করে। এ অবস্থায় দাউদকান্দি ফেরিঘাটের কাছে তিনি সাঁতরিয়ে মেঘনা নদী পার হন। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতে পৌঁছাতে সক্ষম হন।

যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তার বিভিন্ন অপারেশন, অভিযান পাকিস্তানিদের মতো ততকালীন সময়ের উন্নত একটি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে দলবদ্ধ ও একক সাহসিকতার ঘটনা গুলো কল্পনাকেও হার মানায়!

৭১-এর ২৮ শে সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের বিমান ঘাঁটিতে গঠন করা হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম কিলো ফ্লাইট। ১০জন পাইলট, ৬৭ জন টেকনিশিয়ান, একটি এলয়েড থ্রি হেলিকপ্টার, একটি অটার ও একটি ডিসি থ্রি ডকোডা উড়োজাহাজ নিয়ে যার যাত্রা শুরু, প্রশিক্ষণ চলে ২ মাস। কিলো ফ্লাইটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুলতান মাহমুদ।

ঐ সময়ে ভারতে সমবেত হওয়া পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর আরও কয়েকজন বাঙালি মুক্তিবাহিনীর প্রধান এম এ ওসমানীর কাছে অনুরোধ করেন মুক্তিবাহিনীর জন্য বিমান উইং গঠনের। কিন্তু বাস্তবে তা তখন করা সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় সুলতান মাহমুদ বসে থাকলেন না। যোগ দেন স্থল যোদ্ধাদের সঙ্গে। তিনি প্রথমে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরে। পরে ঝাপিয়ে পড়েন ১ নম্বর সেক্টরের রণাঙ্গনে। বেশ কয়েকটি অপারেশনে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে অংশ নেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাবস্টেশন ধ্বংসের অপারেশন উল্লেখযোগ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মদুনাঘাট বিদ্যুৎ স্টেশনটির অবস্থান চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কের হালদা নদীর পশ্চিম পাশে। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল। সাবস্টেশনের চারদিকের বাংকারে ছিল তাদের অবস্থান। অক্টোবর মাসের শেষে একদিন সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে অতর্কিতে আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে সাবস্টেশনটি ধ্বংস হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে সুলতান মাহমুদ আহত ও তার এক সহযোদ্ধা শহীদ হন। সেদিন তিনি যথেষ্ট রণকৌশল ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এরপর তিনি আর স্থলযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি।

এ সময়ই গঠিত হয় মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং। কয়েক দিন পর সুলতান মাহমুদকে বিমান উইংয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের মাধ্যমে প্রথম যে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়, এর একটির দায়িত্ব ছিল তার ওপর। তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয় গোদনাইল অপারেশন। এ অপারেশনে তার সহযোদ্ধা ছিলেন বদরুল আলম। তারা একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারের সাহায্যে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেলের ডিপোতে আক্রমণ চালান। ভারতের কৈলাসটিলা বিমানঘাঁটি থেকে পূর্ব নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তারা গোদনাইলে পৌঁছাতে সক্ষম হন। নির্ধারিত দূরত্বে পৌঁছেই শুরু করেন আক্রমণ। সেদিন তারা হেলিকপ্টার থেকে ১৪টি রকেট নিক্ষেপ করে ইএসএসও-র দুটি তেলের ডিপো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেন। আরও কয়েকটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুলতান মাহমুদ পরে সিলেট, কুলাউড়া, কুমিল্লা, ভৈরব, শমশেরনগর আরও কয়েক স্থানে হেলিকপ্টারের সাহায্যে আক্রমণে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি ও বীরউত্তম সাহাবউদ্দিন আহমেদ একদিন হেলিকপ্টারে সিলেট শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বিমানবন্দরে অবতরণ করা মাত্র তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েন। হেলিকপ্টারে কয়েকটি গুলি লাগে। সুলতান মাহমুদ অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে হেলিকপ্টারটি নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের কবল থেকে বেরিয়ে যান।

এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তার অসংখ্য দু:সাহসিক অভিযান বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য ভুমিকা রাখে।

আকাশসীমা ও স্থলভাগে সুলতান মাহমুদ, বীরউত্তম শামসুল আলম ও তাদের সঙ্গীদের দুর্ধর্ষ সব অভিযানকে মূল উপজীব্য করে দীপংকর দীপন ‘ডু অর ডাই’ চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন যা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রথম কোন একশন থ্রিলার জনরার সিনেমা হতে চলেছে। তবে সাম্প্রতিককালে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেতে থাকা আমাদের দেশিয় সিনেমার মুকুটে নতুন নতুন পালক যুক্ত করতে যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এমন আরো কিছু সিনেমার নির্মাণ প্রয়োজন। বাকীটুকু হয়তো আমাদের স্ক্রিপ্ট রাইটার ও প্রযোজক পরিচালকদের হাতে!

যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত সুলতান মাহমুদ বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে তিনি স্বাধীনতা পদক পান। তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনস্বরূপ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন গুলশান-২ এর ৫০ নম্বর রোডকে বীর উত্তম সুলতান মাহমুদ সড়ক নামকরণ করেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে নিভৃতচারী এই গুণীজন ১৯৪৪ সালে ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার এক মেয়ে ও এক ছেলে ছাড়াও দুই ভাইদের অন্য দুজন হলেন নুরউদ্দিন মাহমুদ কামাল এবং জহিরউদ্দিন মাহমুদ মামুন। সুলতান মাহমুদের বাড়ি দাগনভূঁইয়া উপজেলায়। শুধু জেলা, উপজেলার একজন বিশিষ্ট ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবেই নয় বরং বাংলাদেশ ও বাঙ্গালি জাতি যতদিন এই পৃথিবীর বুকে থাকবে ততদিন ইতিহাসের পাতার তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে!

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর