আর্জেন্টিনা ব্রাজিল এবং আমাদের ফুটবল প্রেম

admin
  • আপডেট টাইম : ডিসেম্বর ০৪ ২০২২, ১২:৫০
  • 598 বার পঠিত
আর্জেন্টিনা ব্রাজিল এবং আমাদের ফুটবল প্রেম

ইয়াহহিয়া নয়ন:

কাতারে চলছে বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা। সারাবিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের নজর সেদিকে। মূল আলোচনায় রয়েছে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। এই দুই দলের প্রতিযোগিতাকে ফুটবলের হাই-ভোল্টেজ প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলা হয়। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যে ফুটবলের এই আইকনিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব সময় দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করেছে এবং একটি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে এই সুন্দর খেলাটি আরও উন্নত করেছে।

আন্তর্জাতিক ফুটবলের সবচেয়ে বড় ম্যাচ হচ্ছে নিঃসন্দেহে আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল। এত বছর ধরে ফুটবল বিশ্বকে অনেক আনন্দ দিয়েছে দুই দল। দুই দেশের এই জনপ্রিয়তার কাছে হার মেনেছে অন্যান্য দল। শুধু ফুটবল প্রতিভা দিয়েই নয়, সাফল্যের দিক দিয়েও এই দুই দলের অবস্থান বিশ্ব ফুটবলে বেশ উঁচুতে।

আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল দলের সারাবিশ্বের সব ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীকে শুভ কামনা জানাই। খেলায় হারজিত থাকবে, কিন্তু পরাজিত হলেও যেন আমরা ফুটবল খেলা উপভোগ করার সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত না করি। আমরা যেন অতি আবেগে ভেসে না যাই। ফুটবল আমাদের সবার ভালোবাসার অংশ হয়ে থাকবে সব সময়।

এই দুই দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ খেলাগুলোও বেশ উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। যে কোনো প্রতিযোগিতায় তাদের মুখোমুখি অবস্থান খেলার মাঠে ও মাঠের বাইরে সব সময় উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।

ফুটবল জগতের বাইরেও আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের মধ্যে এক সময় সুস্থ সম্পর্ক ছিল না। তারা প্রায়ই রাজনৈতিক বিবাদে লিপ্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক খারাপ ছিল। ১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকে ব্রাজিলের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা ছিল।

উভয় দেশ একে অপরের শত্রু ছিল এবং সামরিক একনায়কত্বের অধীনে ছিল। দুই দেশের মধ্যে ফুটবল প্রতিযোগিতা তাদের রাজনৈতিক সমস্যাগুলো মিটিয়ে নিতে কিছুটা সহায়ক ছিল, এবং উভয় দেশকে একত্রিত করতেও সহযোগিতা করেছে। সব মিলিয়ে এই দুই দলের ভক্তরা থেকেছে মুখোমুখি অবস্থানে। বাংলাদেশে ফুটবলপ্রেমিরাও ঠিক তাই। কে কার চেয়ে কোন দিক দিয়ে সেরা তা বিশ্লেষণ করার সুযোগ কেউ ছাড়ে না।

ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা অনেক কিংবদন্তি খেলোয়াড় তৈরি করেছে। পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি, রোনালদো, রোনালদিনহো, রোমারিও, রবার্তো কার্লোস, কাকা, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, ক্যারিয়ার, ক্রেসপো এবং নেইমারসহ বিশ্বের অনেক কিংবদন্তি ফুটবলার এই দুই দেশের।

এই দুই দেশের মধ্যে প্রথম ফুটবল খেলাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯১৪ সালে। কিন্তু এই প্রথম ম্যাচটি বাতিল করা হয়, কারণ ওই সময় ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের নিয়ে জাহাজ দেরিতে পৌঁছায়। ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ সালে ব্রাজিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯১৪ সাল থেকেই আর্জেন্টিনা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আধিপত্য বিস্তারকারী শক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল।

ব্রাজিলের পাশাপাশি তাদের বিশ্বব্যাপী সমর্থক বাড়তে থাকে। ১৯৭০ এ আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বিপর্যয়কর সময় পার করতে হয়। কোনো জয় নেই, অগণিত পরাজয় এবং ড্র নেই। এই অন্ধকার সময় কাটিয়ে ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে নেয়। বিশ্বব্যাপী জেগে ওঠে তার সমর্থকরা।

আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল ১১৩ বার একে অপরের বিরুদ্ধে খেলেছে। ব্রাজিল ৪৬ বার জয় পেয়েছে, আর আর্জেন্টিনা ৪১ বার জিতেছে এবং ২৬টি ম্যাচ ড্র হয়েছে। ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতেছে পাঁচবার, আর্জেন্টিনা জিতেছে দুইবার।

কোপা আমেরিকার ৪৭টি ইভেন্টের মধ্যে আর্জেন্টিনা ১৫ বার, ব্রাজিল ৯ বার জিতেছে। আর্জেন্টিনা অলিম্পিক ফুটবলের ট্রফি জিতেছে দুবার, কিন্তু ব্রাজিল অলিম্পিক ট্রফি জিততে পারেনি। এই ফলাফল থেকে বোঝা যায় কোনো দল কোনো অংশে কম নয়।

বেশ কয়েকটি আয়োজনে উভয় দলের একে অপরকে অপমান করার অভিজ্ঞতাও আছে। ১৯৪৬ সালে দুই দলই কোপা আমেরিকায় মুখোমুখি হয়েছিল। সেই ঘটনা আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলায় সহিংসতার সাক্ষী হয়ে আছে। আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়দের মধ্যে শারীরিক দ্বন্দ্ব হয়। পরে উভয়ে আবারও মুখোমুখি হয় এবং ফুটবলের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা প্রতিযোগিতার প্রভাব তাদের ভক্ত এবং ফুটবল অনুরাগীদের ওপরে পড়েছে। এটি উভয় দেশের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। দক্ষিণ আমেরিকার মানুষেরা তাদের ফুটবল ক্লাব এবং দেশের প্রতি নিবেদিত। তারা ফুটবলকে তাদের ধর্ম বলে উল্লেখ করে। উভয় দেশ খেলা দেখার জন্য একে অপরের সীমানা লঙ্ঘন করার ঘটনাও ঘটেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোতে আর্জেন্টিনা তার ভক্তদের সমর্থন বেশি পেয়েছে। মাঠের বাইরে থেকে ভক্তরা সব সময় আর্জেন্টিনা দলকে উৎসাহ জুগিয়েছে। ভক্ত ও ফুটবল অনুরাগীদের ভালোবাসা তারা সব সময় পেয়ে এসেছে। সেই তুলনায় ব্রাজিল তার ভক্তদের কাছ থেকে এমন ধারাবাহিক সমর্থন ও উৎসাহ পায়নি। তবুও অপ্রতিরোধ্য ব্রাজিল দল বিশ্ব ফুটবলে কোটি কোটি ভক্তের মন জয় করেছে।

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা উভয় দেশেই বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাড়ছে। এক্ষেত্রে অবশ্য আর্জেন্টিনার চেয়ে ব্রাজিল অনেক অনেক এগিয়ে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্জেন্টিনার চেয়ে ব্রাজিলে সাড়ে ১১ গুণ বেশি পণ্য রপ্তানি করেছেন।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনায় ৯৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ব্রাজিলে রপ্তানি হয়েছে ১০ কোটি ৯২ লাখ ডলারের পণ্য, যা এর আগের বছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছিল ৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য।

বাংলাদেশ থেকে ব্রাজিলে যেমন পণ্য রপ্তানি হয়, তেমনি সে দেশ থেকে আর্জেন্টিনার চেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশ পণ্য আমদানি করে, সেগুলোর মধ্যে পরিমাণের দিক থেকে ব্রাজিলের অবস্থান সপ্তম। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্রাজিল থেকে ২৪০ কোটি ডলারের ৩৪ লাখ ৬৬ হাজার টন পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ থেকে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় প্রায় একই ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়—ওষুধ, প্লাস্টিক পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, জুতা, শিশুদের খেলনা, ম্যাট্রেস, চিকিৎসা সরঞ্জাম ইত্যাদি। তবে উভয় দেশে পণ্য রপ্তানির সিংহভাগই তৈরি পোশাক।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, করোনার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্রাজিলে ১০ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। পরের বছর সেটি কমে সাত কোটিতে দাঁড়ায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে নেইমারদের দেশে।

এই দুই দলের মধ্যে মনোমুগ্ধকর ফুটবল প্রতিযোগিতা সবাইকে সব সময় বাড়তি আনন্দ দেয়। বিশ্বকাপের কারণে এই উন্মাদনা অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে এই দুই দলের কারণে। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমিদের বেশিরভাগ হচ্ছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের সমর্থক। বাংলাদেশে বিশ্বকাপ নিয়ে এত উত্তেজনার মূলেও আছে এই দুই দলের সেরা নৈপুণ্য।

আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল দলের সারাবিশ্বের সব ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীকে শুভ কামনা জানাই। খেলায় হারজিত থাকবে, কিন্তু পরাজিত হলেও যেন আমরা ফুটবল খেলা উপভোগ করার সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত না করি। আমরা যেন অতি আবেগে ভেসে না যাই। ফুটবল আমাদের সবার ভালোবাসার অংশ হয়ে থাকবে সব সময়।

লেখক: সাংবাদিক।

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর