অনিশ্চিত ২৯৪ উন্নয়ন প্রকল্পের মূল্যায়ন

admin
  • আপডেট টাইম : নভেম্বর ১০ ২০২২, ২১:১৬
  • 598 বার পঠিত
অনিশ্চিত ২৯৪ উন্নয়ন প্রকল্পের মূল্যায়ন

নিজস্ব প্রতিবেদক/ টালবাহানা চলছে ২৯৪ প্রকল্পের সমাপ্ত প্রতিবেদন (পিসিআর) নিয়ে। নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই পিসিআর জমা দিতে হয় বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি)।

কিন্তু যথাসময়ে এটি দিতে গড়িমসি করছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এক্ষেত্রে ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, সময়মতো পিসিআর জমা দেননি ২৯৪টি উন্নয়ন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। সেখানে আগের কয়েক বছরের প্রকল্পও আছে।

এর মধ্যে অনেকগুলো শেষ হওয়ার ১ থেকে সাড়ে ৩ বছর সময় পেরিয়ে গেছে। ফলে এসব প্রকল্পের মূল্যায়ন কার্যক্রম আটকে আছে। এছাড়া প্রকল্পের প্রভাব, কার্যক্রমে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি আছে কি না, এটি গ্রহণের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে কি না-এসব বিষয়ে অন্ধকারে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি প্রকাশিত আইএমইডির বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, আমলারা কেউ কারও কাছে জবাবদিহি করতে চান না। এটা একটা বড় সমস্যা। নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের উচিত সময়মতো পিসিআর জমা দেওয়া। আমরা বারবার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আইএমইডির এমন কোনো আইনগত ক্ষমতা নেই যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বাধ্য করবে। ফলে আমরা শুধু বারবার চিঠি দিয়েই যাব। এছাড়া তো কিছুই করার নেই।

সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কি না, প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটুকু পূরণ হয়েছে, ব্যয় কতটা বেড়েছে বা সময় কতটা বেড়েছে-এরকম নানা বিষয় সরেজমিন পরিদর্শন করে খতিয়ে দেখা হয়। পিসিআর না পলে সেটি করা সম্ভব হয় না। এজন্যই এই পিসিআর জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের চরম দায়িত্বে অবহেলায়ও পিসিআর পেতে দেরি হয় বলে জানা গেছে।

আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পিসিআর নিয়ে টালবাহানা দিনদিন বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের নির্ধারিত সময়ে পিসিআর জমা দেওয়া হয়নি ১৩৬টি প্রকল্পের। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে নির্ধারিত সময়ে জমা দেওয়া হয়নি ১২০টি প্রকল্পের পিসিআর। একাধিকবার তাগাদা দিয়েও অনেক প্রকল্পের পিসিআর সময়ের মধ্যে নিয়ে আসতে পারেনি আইএমইডি।

আইএমইডির সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামান যুগান্তরকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প শেষে তারা হিসাব মেলাতে পারেন না। ফলে পিসিআর দিতে চান না। আমরা বারবার তাগাদা দিচ্ছি। কিন্তু তারা না শুনলে প্রশাসনিকভাবে কিছুই করার থাকে না। পিসিআর দেওয়া না হলে সমাপ্ত প্রকল্পের মূল্যায়ন কার্যক্রম আটকে থাকে। এতে প্রকল্পটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারা যায় না। এটা প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা ছাড়া কিছুই নয়।

প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত অর্থবছরে পিসিআর জমা দেইনি এমন প্রকল্পের মধ্যে আইএমইডির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-১-এর প্রকল্প রয়েছে ৩৮টি। এছাড়া পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-২-এর ৫৪টি, সেক্টর-৩-এর ৩৬টি, সেক্টর-৪-এর ৫টি, সেক্টর-৫-এর ৪০টি, সেক্টর-৬-এর ২৬টি, সেক্টর-৭-এর ৪১টি এবং সেক্টর-৮-এর ৫৪টি প্রকল্প রয়েছে।

যেসব প্রকল্পের পিসিআর সময়মতো আসেনি, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড প্রোডাক্টিভিটি (বি-সেপ) শীর্ষক প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এটির পিসিআর পাওয়া যায়নি। এছাড়া ফরেন সার্ভিস একাডেমির (সুগন্ধা) অবকাঠামোগত উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প ২০১৬ সালের জুনে শুরু হয়ে শেষ হয় ২০২০ সালের জুনে। কিন্তু দুই বছরেও পিসিআর জমা দেওয়া হয়নি। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়। প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও আসেনি পিসিআর। মুন্সীগঞ্জ জেলা স্টেডিয়াম এবং বিদ্যমান সুইমিংপুলের অধিকতর উন্নয়নসহ ইনডোর স্টেডিয়াম ও টেনিস কোর্ট নির্মাণ প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। এটির বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয়েছে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। প্রায় আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও পিসিআর পায়নি আইএমইডি।

পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্প শেষ হলেও পিসিআর না দেওয়াটা আর্থিক ও শৃঙ্খলাপরিপন্থি কাজ। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা। আমাদের একটা ফরমেট আছে। প্রকল্প শেষে সেটি পূরণ করতে হয়। এটি খুব জটিল কিছু না হলেও প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা পূরণ করতে ভয় পান। কেননা তারা ভাবেন আমরা তো চলেই যাচ্ছি। পরে যা হয় হবে। ফলে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন না। এটা ঠিক নয়।

কথা হয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাবেক পরিচালক এবং এমএসভিএসবি প্রকল্পে তিন পর্যায়ে প্রায় সাড়ে ৭ বছর প্রকল্প পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করা একেএম আশরাফুল হকের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি সময়ের মধ্যেই পিসিআর জমা দিয়েছিলাম। এটা প্রকল্প পরিচালক হিসাবে আমরা দায়িত্ব মনে করেছি। কিন্তু অন্যান্য প্রকল্প পরিচালক এটা কেন করেন না, সেটি বলা মুশকিল। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালক নেওয়া হয় অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে। এ কারণে প্রকল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা অন্যত্র চলে যান। এমনকি কর্মকর্তারাও অস্থায়ী হওয়ায় চাকরি থেকে চলে যান। ফলে পরবর্তী সময়ে রেকর্ডপত্র আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এর দায়দায়িত্ব তখন বর্তায় প্রকল্পসংশ্লিষ্ট বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের ওপর। কিন্তু তারা তো আর পিসিআর দিতে পারে না।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও পিসিআর আসেনি অনেক প্রকল্পের। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে-ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর সাপোর্ট প্রজেক্ট, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ (ভ্রাট অনলাইন) প্রকল্প। সেকেন্ড স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম সাইজ ইন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট, সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স নির্মাণ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান চত্বরে ১টি বহুতল অফিস ভবন নির্মাণ।

আরও আছে রূপকল্প-২ খনন প্রকল্প: ২টি অনুসন্ধান কূপ (সেমুতাং সাউথ-১ ও জাকিগঞ্জ-১) (বাপেক্স) প্রকল্প, সাপোর্ট ফর প্রিপারেশন অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাস্টার প্ল্যান অ্যান্ড ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রকল্প, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প, ভেড়ামারা (বাংলাদেশ)-বহরমপুর (ভারত) ২য় ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন (বাংলাদেশ অংশ) নির্মাণ এবং অ্যানহেন্সমেন্ট অব ক্যাপাসিটি অব গ্রিড সাব স্টেশন অ্যান্ড ট্রান্সমিশন লাইনস অব রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন প্রকল্প, কুমিল্লা সার্কিট হাউজ নির্মাণ, চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন সমান্তরাল পাইপলাইন নির্মাণ এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১৫ লাখ গ্রাহক সংযোগ (১৯.৫ লাখ গ্রাহক সংযোগের সংস্থানসহ ১ম সংশোধন) প্রকল্প।

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর