ইয়াহিয়া নয়নঃ
বিশ্বের উদীয়মান পাঁচ অর্থনৈতিক শক্তি ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত জোট ব্রিকসে যোগ দিতে চায় ইরান। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের আবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতি – রাজনীতির নতুন চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে ব্রিকস।
তেহরানের সদস্যপদ প্রাপ্তিতে ইরান ও জোট উভয়েরই ব্যাপক লাভ হবে বলে মন্তব্য করেছেন ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র। এছাড়া কেবল ইরানই নয়, আর্জেন্টিনাও এ জোটে যোগ দিতে আবেদন করেছে বলে জানিয়েছে রাশিয়া।
যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট ইউক্রেনে হামলার দায়ে মস্কোকে একঘরে করার চেষ্টা করেছিল, তা যে সফল হয়নি ইরান ও আর্জেন্টিনার এই আবেদনকে তার প্রমাণ হিসেবে দেখাচ্ছে রাশিয়া।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, হোয়াইট হাউস যখন বিশ্বের কোথায় আর কী কী বন্ধ করা যায়, নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায় বা নষ্ট করা যায় তা ভাবছে, ইরান ও আর্জেন্টিনা তখন ব্রিকসে যোগ দেওয়ার আবেদন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মদতপুষ্ট শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ১৯৭৯ সালে হওয়া ইরানি বিপ্লবের পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলো তেহরানকে একঘরে করে রেখেছে। মধ্যপ্রাচ্যের মোট তেলের রিজার্ভের এক চতুর্থাংশের মালিক হওয়ার পরও একের পর এক নিষেধাজ্ঞার কারণে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরানের অর্থনীতি বেশ সংকটেই আছে।
অর্থনৈতিক জোট ব্রিকস বিশ্বের ৪১ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে। বৈশ্বিক জিডিপির এক-চতুর্থাংশ যোগানদাতা এ জোট মোট বৈশ্বিক বাণিজ্যের ১৬ শতাংশের অংশীদার। এ অবস্থায় জোটকে আরও শক্তিশালী করতে সদস্য বাড়াতে চায় রাশিয়া।
সম্প্রতি ব্রিকস জোটের সম্মেলনে অংশ নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন পশ্চিমাদের একটি বার্তা দিয়েছেন। আর তা হলো-ইউক্রেনে হামলার জেরে মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়া একা নয়। আর এরই মধ্যে আর্জেন্টিনা ও ইরানের জোটটিতে প্রবেশের ইচ্ছে প্রকাশ সেই মন্তব্যকেই সমর্থন করছে।
রুশ এবং চীনারা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার দুটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রায়ই আপত্তি তোলে। এ দুটি হলো, এক মেরু কেন্দ্রিকতা এবং সার্বজনীনতা। আরো সহজ করে বললে দাঁড়ায়, দেশ দুটি মনে করে যে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা আমেরিকাকে অনেক বেশি ক্ষমতার যোগান দেয় । এ অবস্থায় তারা এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে বদ্ধপরিকর।
এক মেরু কেন্দ্রিকতা বলতে বোঝায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে কেবল একটিই পরাশক্তি রয়েছে আর সেটি হলো – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রুশ পররাষ্ট্র-নীতি সংক্রান্ত চিন্তাবিদ এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠজন ফিওদর লুকিয়ানভ বিশ্বাস করেন যে বিশ্ব মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যা উপযুক্ত তা করার সক্ষমতা এবং সম্ভাবনা এনে দিয়েছে, এক মেরু কেন্দ্রিকতা। তিনি আরো বলেন, এক মেরু কেন্দ্রিকতা’র মধ্য দিয়ে মার্কিন আধিপত্যের নব যুগের সূচনা হয় ১৯৯১ সালের পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের মাধ্যমে। আমেরিকা এ সময় সাদ্দাম হোসেনের ইরাককে কুয়েত থেকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য একটি বিশ্ব জোট গঠন করে।
১৯৯০-র দশকে বসনিয়া এবং কসোভোসহ বিশ্বজুড়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক হস্তক্ষেপের পরপরই সূচনা হয় উপসাগরীয় যুদ্ধের। ১৯৯৯ সালে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে ন্যাটোর বোমাবর্ষণকে কেন্দ্র করে রাশিয়া দীর্ঘ দিন ধরে বলছে যে ন্যাটো নিছক প্রতিরক্ষা জোট নয়। বেলগ্রেডের চীনা দূতাবাসে ন্যাটো বোমা হামলার ঘটনাও বেইজিং ভুলে যায়নি।
আফগানিস্তানে আমেরিকার পরাজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে ২০২১ সালের গ্রীষ্মে কাবুল থেকে নজিরহীন হযবরল অবস্থায় মার্কিন সেনা প্রত্যাহার। এতে রাশিয়া প্রত্যাশা করছে যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। আসলে, তালেবানের হাতে কাবুলের পতন বার্লিন প্রাচীরের পতনের চেয়ে মোটেও কম ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতীকী হিসেবে বিবেচিত হবে না। চীনের নেতারা বিশ্বাস করেন মহাশক্তির মর্যাদায় চীনের অভ্যুদয় ঘটেছে। চীন এখন বিশ্বব্যবস্থায় একটি নতুন ভূমিকা পালনের অধিকার লাভ করেছে।
চীনারা বিশ্বাস করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা মিলিয়ে যাচ্ছে। এবং একটি বহু কেন্দ্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। প্রেসিডেন্ট শি নিজেও একে আরো সংক্ষেপে তুলে ধরেন। তিনি প্রায়ই বলেন, পূর্বের উদয় ঘটছে এবং পশ্চিম অস্তমিত হচ্ছে।
একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা রাশিয়া এবং চীনের জন্য কেবল অপরিশীলিত শক্তি দেখানোর বিষয় নয়। এটা আদর্শের লড়াইও। পশ্চিমা উদারনৈতিক ঐতিহ্য সর্বজনীন মানবাধিকারের বক্তব্য প্রচার করে। কিন্তু রুশ এবং চীনা চিন্তাবিদরা বলেন যে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সভ্যতা-কে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।
বেইজিং এবং মস্কো যুক্তি দেখায় যে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রয়োজন মনে করলে অন্য দেশের ওপর গণতন্ত্র ও মানবাধিকার চাপিয়ে দিতে পারে আমেরিকা। এ জন্য দরকার হলে সামরিক হস্তক্ষেপেও দ্বিধা করেনা আমেরিকা। রাশিয়া এবং চীন যে নতুন বিশ্বব্যবস্থার দাবি করছে সেখানে এমন বল প্রয়োগের বদলে স্বতন্ত্র প্রভাব বলয়গুলো সুচিহ্নিত থাকবে। নিজ নিজ প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর রাশিয়া এবং চীনের আধিপত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে। পাশাপাশি পুতিন বা শি সরকারকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে এমন রঙিন বিপ্লব বা গণতন্ত্রের প্রতি নিজ সমর্থনও ওয়াশিংটন ত্যাগ করবে।
ইউক্রেনের সঙ্কট হল ভবিষ্যৎ বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে লড়াই। এই সঙ্কটের মধ্য দিয়ে কতোগুলো সুনির্দিষ্ট বিষয় উঠে এসেছে। পুতিনের কাছে ইউক্রেন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবে রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। পশ্চিমা জোট ন্যাটোতে যোগদানের ইউক্রেনের যে কোনো ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভেটো দেওয়ার অধিকার থাকাটা নিরাপত্তার দিক থেকে রাশিয়ার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে। মস্কো দেশটিতে রুশ ভাষাভাষীদের রক্ষক হিসাবে ভূমিকা পালন করারও দাবি করে।, অন্যদিকে এ সব দাবিকে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার কিছু মৌলিক নীতি, বিশেষ করে একটি স্বাধীন দেশের বৈদেশিক নীতি এবং কৌশলগত পছন্দ-অপছন্দ নির্ধারণের নিজস্ব অধিকার বিরোধী হিসেবে দেখছে আমেরিকা।
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে, পুতিন এ যুদ্ধে সফল হলে, তাইওয়ান আক্রমণ করার জন্য শির লোভ দুর্দমনীয় হয়ে উঠবে। আমেরিকান যুগের অবসান হয়েছে অনুভব করে উত্তেজিত জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ থেকে চীনা নেতার উপর অভ্যন্তরীণ চাপও বাড়বে।
লেখক : সাংবাদিক।