চা শ্রমিকদের ২ কোটি টাকা যায় কোথায়?

admin
  • আপডেট টাইম : সেপ্টেম্বর ০১ ২০২২, ২০:৪৫
  • 601 বার পঠিত
চা শ্রমিকদের ২ কোটি টাকা যায় কোথায়?

আখলাছ আহমেদ প্রিয়, হবিগঞ্জ \

হবিগঞ্জে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা শ্রমিকরা আন্দোলনে নামার পর মালিকপক্ষ থেকে মজুরির বাইরে নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার দাবি করে, তবে সেগুলো ঠিকমতো শ্রমিকরা পান না বলেই জানা যাচ্ছে। এবার জানা গেল, মালিকদের মতো শ্রমিকদের ঠকাচ্ছেন তাদেরই নেতারা।
শ্রমিকরা প্রতি মাসে ১৫ টাকা করে চাঁদা দেন তাদের বিপদে-আপদে কাজে লাগার জন্য। এই টাকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করে তা শ্রমিকদের কল্যাণে কাজে লাগানোর কথা। কিন্তু টাকা কী হয়, তা জানা নেই কারও।
সুবিধাবঞ্চিত চা শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে ও তাদের দাবি আদায়ে ১৯৪৮ সালে গঠন করা হয় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষেই চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করে থাকে মালিকপক্ষ। তবে মালিকপক্ষের সঙ্গে ইউনিয়ন নেতাদের আঁতাতের অভিযোগ বিভিন্ন সময় করে এসেছেন শ্রমিকরা। নেতারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়ে শ্রমিকদের নায্য দাবি এড়িয়ে যান বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বাগানের প্রত্যেক স্থায়ী শ্রমিক প্রতি মাসে শ্রমিক ইউনিয়নের তহবিলে ১৫ টাকা করে চাঁদা জমা দেন। এই টাকা কোথায় যায়- এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে? শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের অর্থসম্পদের উৎস নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে তাদের মধ্যে। বছরের পর বছর ধরে এই টাকার কোনো অডিট হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কার্যালয় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে, যেটি লেবার হাউস নামে পরিচিত। শ্রীমঙ্গলেরই একটি অ্যাকাউন্টে জমা হয় শ্রমিকদের মাসিক চাঁদার টাকা। তবে প্রতি মাসে কী পরিমাণ টাকা জমা হয় এবং বর্তমানে অ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ টাকা আছে, তার কোনো হিসাব দিতে রাজি হননি ইউনিয়ন নেতারা।
চাঁদার হিসাব তো দূরের কথা, বাংলাদেশে চা শ্রমিক জনগোষ্ঠী কত তার সঠিক হিসাবই প্রকাশ হয়নি। ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল হ্যান্ডবুক অন বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রি বুক-২০১৯’-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে চা বাগানের সংখ্যা ১৬৬টি। এখানে মোট জনসংখ্যা ৪ লাখ ৭২ হাজার ১২৫ জন। আর চা শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে চা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত লাখ।
তবে দুটি সংগঠনের শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার ১৮৪ জন। এর মধ্যে স্থায়ী ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন এবং অস্থায়ী ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন। স্থায়ী শ্রমিকরা চাঁদা দিলে প্রতি মাসে ইউনিয়ন পায় ১৫ লাখ ৫৬ হাজার ২০৫ টাকা। অর্থাৎ বছরে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৮৬ লাখ ৭৪ হাজার ৪৬০ টাকা।
শ্রমিকরা জানান, প্রতি সপ্তাহে তাদের মজুরি দেয় বাগান কর্তৃপক্ষ। মজুরি দেয়ার সময় মাসের প্রথম সপ্তাহে অথবা শেষ সপ্তাহে যেকোনো এক দিন তাদের মজুরি থেকে ১৫ টাকা করে চাঁদা কেটে রাখে বাগান কর্তৃপক্ষ। পরে সেই টাকা বাগানের কাছ থেকে শ্রমিক ইউনিয়ন সংগ্রহ করে।
শ্রমিক অর্চনা বাউরি বলেন, ‘আমি পাঁচ বছর ধরে পাতা তোলার কাজ করি। এই পাঁচ বছর ধরেই চাঁদা দিয়ে আসছি। কিন্তু এই টাকা কোথায় যায়, কী হয় আমি জানি না। মজুরি দেয়ার সময় আমাদের বলা হয় শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা ১৫ টাকা কাটা হয়।’
চা শ্রমিক নেত্রী সন্ধ্যা রাণী ভৌমিক বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে মাসে ১৫ টাকা চাঁদা নিয়ে নেতারা কী করে তারাই জানে। কথা ছিল শ্রমিকদের কন্যাণে এ টাকা ব্যয় হবে। কিন্তু একটা টাকাও শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় হয় না। একজন শ্রমিক না খেয়ে মরে গেলেও একবার খাবার দেয় না। অসুস্থ হয়ে মরে গেলেও একটা ওষুধের ব্যবস্থা করে না।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার বলেন, ‘অনেক পরিবার আছে টাকার অভাবে মেয়ে বিয়ে দিতে পারে না। মারা যাওয়ার পর শ্রদ্ধানুষ্ঠান করতে পারে না। তখন তো শ্রমিক ইউনিয়ন আর্থিক সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু তারা সেটা করে না।
‘এমনকি যে শ্রমিক বছরের পর বছর তাদের টাকা দিয়েছে, মৃত্যু পর তাদের পরিবারকে টাকা দেয়া কথা। কিন্তু তারা এক টাকা দেয় না। সবগুলো নেতারা ভাগবাটোয়ারা করে খেয়ে নেয়।’
চাঁদার টাকার হিসাব জানেন না বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতিরাও। চাঁন্দপুর বাগানে এই কমিটির প্রধান সাধন সাঁওতাল বলেন, ‘একজন শ্রমিকের পাশে দাঁড়ায় না ইউনিয়ন। শ্রমিকদের ক্যলাণে একটা টাকা তারা ব্যয় করে না।’
তিনি বলেন, ‘এই যে আন্দোলনের কারণে ১৯ দিন শ্রমিকরা কাজে যায়নি। তারা তো এই দিনের মজুরি পাবে না। অনেক পরিবার খেয়ে-না খেয়ে অসহায়ের মতো পড়ে রয়েছে। ইউনিয়ন চাইলে তাদের সহায়তা দিতে পারত। কিন্তু তারা কিছু দেয়নি।’
তবে শ্রমিকদের অভিযোগ অস্বীকার করেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল। তিনি বলেন, ‘ইউনিয়নের টাকা নিয়ে কোনো শ্রমিকের কোনো অভিযোগ নেই। একটি কুচক্রী মহল আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।’

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর