চা শ্রমিক সন্তানদের শিক্ষার খরচ দৈনিক দেড় টাকা !

admin
  • আপডেট টাইম : আগস্ট ৩০ ২০২২, ০৯:৫৯
  • 595 বার পঠিত
চা শ্রমিক সন্তানদের শিক্ষার খরচ দৈনিক দেড় টাকা !

আখলাছ আহমেদ প্রিয়, হবিগঞ্জ \

সন্তানের শিক্ষার কথা তুলতেই হবিগঞ্জে সুরমা চা বাগানের শ্রমিক স্বপ্না সাঁওতাল কাঁদতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘সকালে মেয়েটা কলমের টাকা চাইছে। ২০ দিন ধইরা কাজে যাই না। টাকা কই পাইতাম? দুইটা থাপ্পড় দিয়া কাজে চইলা আইছি। এখন কষ্টে বুকটা ফাইটা যাইতেছে। মা হয়ে একটা কলম না দিয়ে থাপ্পড় মারছি।’
চা বাগানের শ্রমিকদের সন্তানদের পড়াশোনার চিত্রই যেন ফুটে উঠল স্বপ্নার বক্তব্যে। এই জীবন তাকে কোনো স্বপ্ন দেখায় না, কেবলই কাঁদায়।
চা বাগানের শ্রমিকরা মজুরির বাইরে বাড়তি সুবিধার নামে মালিকপক্ষ যা বলে থাকে, তার মধ্যে পোষ্যদের শিক্ষার পেছনে যে ব্যয় দেখানো হয়, তা একেবারেই অপ্রতুল। ফলে শিক্ষার পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। দিনে একেকজন শিশুর পেছনে শিক্ষা ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় টাকা, এই হিসাবে মাসে ৪৫ টাকা, যা মূলত দুটি খাতা কিনতেই খরচ হয়ে যাওয়ার কথা। চা শ্রমিকরা দিনে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে টানা ১৯ দিন আন্দোলন করে ১৭০ টাকা মজুরি অর্জন করেছে।
যখন তারা ১২০ টাকা মজুরি পেত, তখন মালিকপক্ষ দাবি করে আসছিল, রেশন, আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ নানা খাতে খরচ মিলিয়ে ৪০১ টাকা ব্যয় করা হয় একেকজন শ্রমিকের পেছনে। এখন দাবি করা হচ্ছে মজুরি ৫০ টাকা বাড়ায় শ্রমিকের পেছনে ব্যয় বেড়ে হবে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা।
আইন অনুযায়ী এসব সুবিধা কখনও মজুরির অংশ হতে পারে না। আবার খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আবাসন বলতে যে ঘর দেয়া হয়, তাতে মাসে ২৩০০ টাকা মজুরি দেখানো হলেও তাতে নেই আবাসনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। এসব ঘরের ভাড়া সাত থেকে আট শ টাকার বেশি হওয়ার সুযোগ নেই।
রেশন বলতে যে সুবিধার কথা বলা হয়, তাও পর্যাপ্ত নয়। কেবল চাল বা আটা দেয়া হয়। কোনো কোনো বাগানে টানা ৫ বছর আটা দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। আবার যাদেরকে ধানের জমি ইজারা দেয়া হয়, তাদের রেশন দেয়া হয় না। অনিয়মিত শ্রমিকরাও এই রেশন পায় না।
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী চা বাগানে ২৫ জন শিক্ষার্থী থাকলেই বাগান কর্তৃপক্ষকে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যে বাগানগুলোতে সরকারি স্কুল নেই, সেই বাগানের কর্তৃপক্ষ একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান করে দিলেও সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। সরকারি বইগুলো শিক্ষার্থীরা বিনা পয়সায় পেলেও দেয়া হয় না উপবৃত্তি, পোশাক বা খাতা। ব্যবস্থা নেই দুপুরের টিফিনেরও। অধিকাংশ স্কুলেই প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করেন একজনমাত্র শিক্ষক।
শ্রমিকদের দাবি, লেখাপড়া করানোর ইচ্ছে থাকলেও আর্থিক সংকট আর প্রতিবন্ধকতার কারণে লেখাপড়া করাতে পারছেন না। বেশির ভাগই প্রাথমিকেই ঝরে পড়ে। অর্ধেক মাধ্যমিক পর্যন্ত যায়। সেখানেও ঝরে পড়ে অর্ধেকের বেশি।
বেগমপাড়া বাগানের শ্রমিক মণি সাধু বলেন, ‘আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাবারই দিতে পারি না, লেখাপড়া কীভাবে করাব? বাগান থেকে একটা বই, খাতা কলম দেয়া হয় না। এত কম মজুরিতে কীভাবে লেখাপড়া করাব? ছেলেরা এখানে সেখানে কাজ করে লেখাপড়ার খরচ চালায়। কিন্তু মেয়েরা কীভাবে রুজি করবে? তাই তারা হাইস্কুলে যায় না।’
সুরমা বাগানের অর্চনা বাউড়ি বলেন, ‘হাইস্কুলে গেলে অনেক টাকা লাগে। স্কুলের ভর্তি ফি, পরীক্ষার ফি, বই-খাতা কিনতে অনেক সময় আমাদের সন্তানদের টাকা দিতে পারি না। তাহলে তারা কীভাবে লেখাপড়া করবে। আমাদেরও তো ইচ্ছে করে সন্তানদের লেখাপাড়া করাইতে। কিন্তু টাকার অভাবে পারি না। যাদের টাকা আছে, তারা শুধু লেখাপাড়া করাইতে পারে।’
‘বেশির ভাগ স্কুলই এক কক্ষের। একটি কক্ষেই প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে ক্লাস নেয়া হয়। তাও একজনমাত্র শিক্ষক দিয়ে। শিক্ষকের জন্যও আলাদা কোনো কক্ষ নেই এসব বিদ্যালয়ে।’
চা শ্রমিকদের সন্তানদের অর্ধেকের বেশি প্রাথমিকের পরেই ঝরে যায়। তবে ইদানীং কেউ কেউ উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতনও থাকে সামান্য। তাই ভালো মানের কোনো শিক্ষক বাগানের স্কুলে কাজ করেন না। ফলে সেখানকার শিক্ষার মানও খুব খারাপ। বাগানের স্কুল থেকে পাস করে আসা শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাইরের উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায়ই টিকতে পারে না।
চা শ্রমিকদের নিয়ে পিএইচডি করা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আশ্রাফুল করিম বলেন, ‘শিক্ষা নিয়ে মালিকদের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। স্কুলের নামে একটি ছাপড়া ঘর আর একজন শিক্ষক ছাড়া আর কিছুই নেই বেশির ভাগ বাগানে। শহর আর মহাসড়কের পাশের বাগানগুলো ছাড়া বাকিগুলোতে সরকারি বিদ্যালয়ও নেই।’
তিনি বলেন, ‘চা বাগান মালিকরাই তাদের হিসাবে দেখিয়েছেন, শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য দিনে ১.৫০ টাকা ব্যয় করেন তারা। এই যুগে দেড় টাকা দিয়ে কী শিক্ষা মিলবে?’
তবু বদলাচ্ছে দিন
তবে ইদানীং কষ্ট করে হলেও সন্তানদের পড়ানোর দিকে ঝোঁক কিছুটা বেড়েছে। যে কারণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধার-দেনা করেও পাঠানো হচ্ছে সন্তানদের। তবে সেখানেও নানা বাধা।
হবিগঞ্জের বেগমখান বাগানের পরেশ বাগতি বলেন, ‘আমাদের বাগানের অনেক ছেলে কলেজে পড়ে। প্রতি বছর বাগান থেকে ১৮ থেকে ২০ জন ছেলে এসএসসি পাস করছে। কিন্তু কলেজ পর্যায়ে পড়তে গিয়ে অনেকেই ঝরে পড়ে। মেয়েরা কলেজ পর্যায়ে নেই বললেই চলে।’
কেউ কেউ অবশ্য কলেজ পেরিয়ে আরও দূরে যাচ্ছে, যাদের হাত ধরেই দিন বদলের স্বপ্ন দেখছে শ্রমিকরা।
একই জেলার চাঁন্দপুর বাগান, বেগমখান, চন্ডিছড়া ও লস্করপুর চা বাগানের শিক্ষার্থীরা ৬ কিলোমিটার দূরে চুনারুঘাট কলেজ, দেওয়ন্দি বাগানের শিক্ষার্থীরা ৮ কিলোমিটার দূরের শায়েস্তাগঞ্জ কলেজ, আমু ও নালুয়া বাগানের শিক্ষার্থীরা ৭ কিলোমিটার দূরের আমরোড কলেজ এবং সুরমা, জগদীলপুর, নোয়াপড়া, তেলিয়াপাড়া বাগানের শিক্ষার্থীদের অন্তত ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের মাধবপুর কলেজে গিয়ে পড়তে হয়।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ শতাংশ। তবে এর সিংহভাগই ছেলে। আর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করছে ২০ শতাংশ।
‘শ্রমিকরা এখন আগের চেয়ে সচেতন। তারা না খেয়ে হলেও সন্তানদের লেখাপড়া করাতে চান। যে কারণে শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। এমনকি বিভিন্ন ভার্সিটিতে অন্তত ২০০ চা শ্রমিক সন্তান লেখাপড়া করছেন। আমি তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছি।’

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর