নিউজ ডেস্ক: বিশ্বব্যাপী একুশের চেতনা ছড়িয়ে দিতে এবং সারাবিশ্বের মাতৃভাষা সংরক্ষণে আজ সোমবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করছে জাতিসংঘ ও ইউনেস্কো (জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা)। মাতৃভাষার চেতনায় বিশ্ববাসীকে উজ্জীবিত করতে এবং সব মায়ের ভাষা সংরক্ষণে বৈশ্বিক উদ্যোগের পাশাপাশি বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ৬০টি দূতাবাসের ৮১টি মিশনও দিবসটি উদযাপন করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কূটনৈতিক অঙ্গনে একুশের চেতনা (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস) বাংলাদেশের জন্য বৈশ্বিকভাবে সমীহ-জাগানো সাংস্কৃতিক যোগাযোগের শক্তি, যা কূটনীতিতে ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি সব মাতৃভাষা সংরক্ষণে এবং মাতৃভাষার বিকৃতিরোধে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিতে পারে। এজন্য একুশের মূল চেতনার বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাপী একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন জরুরি।
একুশের চেতনা ছড়িয়ে দিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে শহীদ মিনার স্থাপন করা প্রয়োজন উল্লেখ করে ব্রুনাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার নাহিদা রহমান সুমনা বলেন, ‘করোনার কারণে সীমিত আকারে ব্রুনাইয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের আয়োজন করেছি। যার মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ব্রুনাইয়ের অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করব। একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিকালে ভার্চুয়াল মাধ্যমে একুশের চেতনা নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে ব্রুনাইয়ে নিযুক্ত ১৮টি দেশের রাষ্ট্রদূতের ভিডিওবার্তা প্রদর্শন করা হবে।’
সিডনিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ গত বছর প্রতিষ্ঠা পেয়েছে- এ তথ্য জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজেস কনজারভেশন মুভমেন্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা নির্মল পাল বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ইন্দোনেশিয়ার একটি সংগঠন আছে। এবার তাদের সঙ্গে আমাদের সংগঠন যৌথভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপন করবে। পাশাপাশি সিডনিতে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনও দিবসটি উদযাপন করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একুশের চেতনা এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের একুশে অধিকার আছে। একুশের চেতনাকে সারাবিশ্বে যদি প্রচারিত, প্রসারিত করতে পারি, তা হলে একদিকে যেমন বাংলা সংস্কৃতির প্রসার হবে, অন্যদিকে অন্যান্য ভাষাভাষীরা অনুপ্রাণিত হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ প্রতিটি দেশে বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ সরকার এবং ইউনেস্কোর সমঝোতায় আসতে হবে এবং একুশের মূল চেতনা বাস্তবায়নে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।’
কানাডার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘দিবসটি উদযাপনে এবার কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে র্যালি ও মানববন্ধনসহ একাধিক আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষীরা অংশ নেবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘কানাডা সরকার যাতে রাষ্ট্র্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে স্বীকৃতি দেয় এজন্য আমরা কাজ করছি। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সিনেটর মবিনা জাফর এরই মধ্যে দেশটির সিনেট থেকে এ সংক্রান্ত একটি বিলের অনুমোদন পেতে সহযোগিতা করেছেন। সামনে বিলটি কানাডার পার্লামেন্টে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। কানাডার পার্লামেন্টে এ বিষয়ে অনুমোদন পেতে দেশটির এমপি ক্যান হার্ডি স্পন্সর করছেন। কানাডার পার্লামেন্টে এই বিলটি অনুমোদন পেলে কানাডা হবে প্রথম দেশ, যারা রাষ্ট্রীয়ভাবে একক দেশ হিসেবে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।’
কানাডার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘একুশের চেতনা ছড়িয়ে দিতে এর আগে আমরা কানাডার সারা শহরে একটি স্থায়ী মনুমেন্ট স্থাপন করেছি। এবার ভ্যাঙ্কুভারে শহীদ মিনারের আদলে একটি মনুমেন্ট স্থাপন করতে যাচ্ছি। পাশাপাশি একুশের চেতনাকে বৈশ্বিক পর্যায়ে আরও ছড়িয়ে দিতে ভ্যাঙ্কুভারে স্থাপন করতে চাওয়া শহীদ মিনারকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এজন্য সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কাজ করছি। বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি, তারা যদি দেশের প্রতিটি মিশনে শহীদ মিনারের এই প্রতীক সম্পর্কে অবহিত করে, এতে একুশের চেতনার বিকাশ ত্বরান্বিত হবে।’
কানাডার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিস্তম্ভ বাস্তবায়ন কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আলী বুখারি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কানাডায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশি-কানাডিয়ান কমিউনিটি সার্ভিসেসের (বিসিএস) আয়োজনে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি (এই লাইনটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে সেমিনারটি ইংরেজিতে অনুষ্ঠিত হয়)।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশন জানিয়েছে, কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল অব লিবারেল আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স ও টেলরস ইউনিভার্সিটির যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ১৭ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে ‘মহামারি ও ভাষা’ শীর্ষক একটি প্যানেল আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই সেমিনারে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণের চেতনাকে বহন করে। টেলরস ইউনিভার্সিটির নির্বাহী ডিন অধ্যাপক ড. লিথিয়ানান্থন আরি রাগাভান বলেন, ভাষাসৃষ্ট যোগসূত্র সংস্কৃতির দেয়াল পেরিয়ে যেতে পারে। কোভিড-১৯ মহামারি ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, চলমান মহামারি কাটিয়ে উঠতে হলে ভাইরাসের ভাষা, রাষ্ট্রের ভাষা এবং জনগণের ভাষার মধ্যে মেলবন্ধন তৈরির কোনো বিকল্প নেই।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটেনের একাধিক শহরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। ম্যানচেস্টার শহরে দিবসটি উদযাপনে বহু ভাষাভাষীর সমন্বয়ে কবিতা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। আয়ারল্যান্ডে দিবসটি উদযাপনে সেমিনারসহ একাধিক আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে নানা আয়োজন করা হয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম জাতিসংঘের কাছে সর্বপ্রথম একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানান। মাঝে অনেক ঘটনার পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ওই সময় ১৮৮টি দেশ এতে সমর্থন জানিয়েছিল। ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো যথাযথ মর্যাদায় পালন করছে। এরপর ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ মর্মে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।