বিয়ানীবাজারে ডিজিটাল মাধ্যমে ভাষার বিকৃতি বেসামাল

admin
  • আপডেট টাইম : ফেব্রুয়ারি ২০ ২০২২, ১৫:৩৪
  • 616 বার পঠিত
বিয়ানীবাজারে ডিজিটাল মাধ্যমে ভাষার বিকৃতি বেসামাল

স্টাফ রিপোর্টার:

 

‘হেই ব্রো’, ‘ভাল্লাগছে ভায়া’, ‘খাইতে মুন চায়’, ‘কিয়েক্টা বস্তা’, ‘জটিলস’- এ শব্দগুলো এখন সবার মুখে মুখে। বিকৃত এইসব শব্দ প্রয়োগ করে বিয়ানীবাজারে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা হচ্ছে। এসব মাধ্যমে লেখালেখির সূত্র ধরে বিকৃতির প্রভাব দ্রুত ছড়াচ্ছে। ইউটিউব, এমএম রেডিও এসব শব্দের জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে তুলছে। এখানকার নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে বিকট শব্দের সংমিশ্রণের ভাষার আদান-প্রদানে। গত কয়েকবছরে উপজেলায় ভাষা বিকৃতি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।

 

বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিয়ানীবাজারের তরুণ প্রজন্ম সাধারণ সম্বোধন কিংবা কুশল বিনিময় করার ছোট্ট বাক্য অনেকে উচ্চারণ করছেন বিকৃত শব্দ-বাক্য ও স্বরে। অথচ বাংলা ভাষার দূষণ ও বিকৃতি রোধে হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ২০১৪ সালে হাইকোর্টই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর আদেশ দেন। কিন্তু ওইসব আদেশ, আইন ও বিধিনিষেধের পরও সর্বত্র বাংলা ভাষার দূষণ ও বিকৃতি চলছেই।

 

বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ সহযোগী অধ্যাপক তারিকুল ইসলাম বলেন, বিকৃতি ও ভাষার ব্যবহারে অসচেতনতা আর শব্দের পব্যবহারের কারণে ভাষা বিলুপ্ত হতে থাকে। এর সঙ্গে আছে বিদেশি ভাষার আগ্রাসন। যেকোনো ভাষার কাজ হলো গতিময় নদীপ্রবাহের মতো বয়ে চলা। তবে ভাষার গতিশীল বির্বতন আর বিকৃতি এক কথা নয়। তিনি বলেন, চর্চার ওপর ভাষার সমৃদ্ধি নির্ভর করে। চর্চা না থাকলে বা বিকৃতি ঢুকে গেলে ভাষা দ্রুত বিলুপ্ত হতে থাকে। পৃথিবীতে ভাষা বিলুপ্তির অনেক উদাহরণ আছে। আবার এমন অনেক ভাষা আছে, যেগুলো হারিয়ে যাওয়ার পরও নতুন করে চর্চার মাধ্যমে পুরনো রূপে ফিরে এসেছে।

 

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এফএম রেডিও, ইউটিউব চালু করলেই শোনা যায় ‘হ্যালো লিসেনার্স, ‘হ্যালো ভিউয়ার্স’। তরুণদের মুখে মুখে ‘আবার জিগায়’, ‘খাইলেই দিলখোশ’, ‘এক্সট্রা খাতির’, ‘বেইল নাই’ ইত্যাদি নানান ভাষার ব্যবহার। আবার নাটকের নাম ‘ডেট ফেল’, ‘হাউসফুল’, ‘বাংলা টিচার’, ‘ফুল ম্যাড’ ইত্যাদি বেশ আলোচিত। নাটকে যে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে তা না-আঞ্চলিক, না-প্রমিত। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে এরকম নানা শব্দ ঢুকে বাংলা ভাষাকে দূষিত করছে, বিকৃত করছে।

 

 

বাংলা ভাষার বিকৃতি রুখতে ২০১২ সালে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বেশ কয়েক দফার নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে রেডিও ও টেলিভিশনে ‘বিকৃত উচ্চারণ’ এবং ‘ভাষা ব্যঙ্গ’ করে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই আদেশে আদালত বলেন, বাংলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে। এই ভাষার প্রতি আর কোনো আঘাত যাতে না আসে, সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে।

 

হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়, ভাষাদূষণ রোধে আইন তৈরি করে বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেল এবং দেশি বেতার ও টেলিভিশন নিয়ন্ত্রণ; বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে প্রমিত বাংলা ভাষার একটি কোর্স চালু এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পঠন-পাঠন প্রবর্তনের উদ্যোগ; বেতার ও টেলিভিশনে প্রমিত বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত এবং ভাষায় বিদেশি শব্দের অকারণ মিশ্রণ দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাষার বিকার ও দূষণ রোধে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স রেগুলেটরি কমিশনের ব্যবস্থা গ্রহণ; বেতার ও টেলিভিশনে ভাষাদূষণ রোধ।

 

বিয়ানীবাজারের দাসউরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, ভাষা গতিশীল। ভাষা গতিময় রাখার দায়িত্ব আমাদের। পৃথিবী এখন বিশ্বপল্লীতে রূপ নিয়েছে। তাই নানা সংস্কৃতি এসে আশ্রয় নেয়। তিনি বলেন, ভাষার পরিবর্তন ও বির্বতন হবে; কিন্তু বিকৃতি থেকে দূরে থাকতে হবে। ভাষা চলমান হলেও এর মৌলিক ব্যাকরণ থেকে বিচ্যুতি করা যাবে না।

 

বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজের প্রভাষক সঞ্জয় আচার্য বলেন, এ ভাষাকে ‘খিচুড়ি ভাষা’ না বলে ‘বিকট ভাষা’ বলাই শ্রেয়। খিচুড়ি বা বিকট যে নামেই বলি না কেন, এই ভাষারীতি নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করলেই অনেকে আঞ্চলিক ভাষার দোহাই দেন। আঞ্চলিক ভাষা নয়, আজ বিপত্তি ও আপত্তি বিকট ভাষা নিয়ে।

দাসউরা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি মজির উদ্দিন আনসার বলেন, একটি দেশে দুটি ভাষা থাকে। একটি মান ভাষা, অন্যটি আঞ্চলিক ভাষা। মান ভাষা হচ্ছে প্রমিত ভাষা। আমাদের কিছু আঞ্চলিক ভাষার অন্যতম হচ্ছে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, রংপুর অঞ্চলের ভাষা। তিনি বলেন, আঞ্চলিক ভাষা মূল ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যম বিশেষ করে রেডিও জকিদের মাধ্যমে ভাষা দূষিত হচ্ছে। ভাষার বিকৃতি হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের কোনো ভাষানীতি নেই। ভাষা পরিকল্পনা নেই।

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর