মিসবাহ উদ্দিন, বিয়ানীবাজার প্রতিনিধিঃ
বিয়ানীবাজারে করোনা সংক্রমণে যেমন ঊর্ধ্বগতি, তেমনি গতি বাড়ছে টিকা দেওয়ায়ও। সেই অনুপাতে পিছিয়ে কভিড-১৯ শনাক্তকরণ। অর্থাৎ পিছিয়ে পড়েছে পরীক্ষা। এ নিয়ে স্থানীয় সচেতনমহলের মনে হতাশাও কাটছে না। পরীক্ষা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন তাঁরা। সচেতনমহলের মতে, যত দ্রুত বেশি মানুষের পরীক্ষা করা যাবে, তত সংক্রমণের সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে। আর রোগী শনাক্ত করা গেলে নিয়ন্ত্রণকাজ আরো সহজ হবে।
সারাদেশের ন্যায় বিয়ানীবাজারেও করোনা সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপজেলায় করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এখানে চলতি জুলাই মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যু মহামারির দেড় বছরে আগের সব মাসের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি হিসাবেই বিয়ানীবাজার উপজেলায় প্রতিদিন আক্রান্ত-মৃতের সংখ্যা উদ্বেগজনক। এর বাইরেও বিভিন্ন গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু।
বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, উপজেলায় বর্তমানে করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা ১২০জন। মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৭৫১, মারা গেছেন ৪৩জন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, বিয়ানীবাজারের ১২০জন করোনা পজিটিভ রোগীর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। তারা যত্রতত্র ঘুরছেন, বাজার-সদাই করছেন। এ-বাড়ি-ও-বাড়ি যাচ্ছেন। এই ১২০ পরিবারের সদস্য সংখ্যা হবে কমপক্ষে ৭শ’। এদের অবাধ বিচরণে উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গত ১৯ জুলাই স্থানীয় গ্যাসফিল্ডে কর্মরত জনৈক ব্যক্তি করোনা পজিটিভ হওয়ার পরও নিজে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপস্থিত হয়ে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট নিতে যান। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তোলপাড় শুরু হয়।
সূত্র জানায়, উপজেলা প্রশাসন গত কয়েকমাস পূর্বে করোনায় আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে পজিটিভ ব্যক্তি কিংবা তার পরিবার নিয়ে সবার ধারণা অজ্ঞাত থেকে যায়। এ সুযোগে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যরা সর্বত্র চলাফেরা করছেন। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হল ঘরে থাকা, বিনা প্রয়োজনে বাইরে না আসা-এমনটি জানান বিয়ানীবাজার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আবু ইসহাক আজাদ। তিনি আরো বলেন, মাস্ক পরিধান এবং স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পজিটিভ রোগীদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করার বিষয়টি পুণ:বিবেচনা করার দাবী জানিয়েছেন অনেকে।
উপজেলার গ্রামে-গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে কেউ না কেউ সর্দি, জ্বর-কাশি ও গলায় ব্যথায় আক্রান্ত। এদের বেশির ভাগই নমুনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহী নয়। তাই ঘরে বসেই প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন করছেন তারা। যাদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো তারা হয়তো কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে না। সর্দি-কাশি-জ্বর শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যাচ্ছেন বাড়িতেই। কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে যাওয়ায় বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। গত কয়েকদিন থেকে উপজেলায় কিছুক্ষণ পরপর মৃত্যুর সংবাদ শোনা যায়।
বর্তমানে বিয়ানীবাজারে অন্য রোগী, কভিড রোগী, টিকা দিতে আসা মানুষ, পরীক্ষার জন্য আসা মানুষে একাকার হয়ে সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে।
বিয়ানীবাজারের চিকিৎসক ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা তো জানি, প্রতিদিন যা শনাক্ত হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি আক্রান্ত। পরীক্ষার বাইরে থাকায় ওই মানুষগুলোর অনেকে উপযুক্ত সময়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। নমুনার সংখ্যা বাড়ানো গেলে গোপন রোগীরা বেরিয়ে আসবে। এটি চিকিৎসা ও সংক্রমণ রোধে সহায়ক হবে।’
তিনি বলেন, ‘শনাক্ত হওয়া মানুষগুলো অন্তত নিজেরা জানতে পারবে যে তারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তখন নিজ থেকে সতর্কতা অবলম্বন করবে। আর যাদের হাসপাতালে যাওয়ার মতো অবস্থা তারা আগেভাগে হাসপাতালে যেতে পারবে।’
এই চিকিৎসক আরো বলেন, ‘এখনো সময় আছে; যেভাবে গ্রামে গ্রামে টিকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; সেভাবেই গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে করোনা টেস্ট করা যায়। ইউনিয়ন বা কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত এগুলো সম্প্রসারণ করা যায়। যথাসময়ে পরীক্ষা হলে চিকিৎসার সুযোগে মৃত্যুও অনেক কমবে। টিকা দেওয়াও সহজ হবে। যারা পজিটিভ হবে তারা পরে টিকা নেবে।’
জানা যায়, বিয়ানীবাজারে অনেকে করোনার উপসর্গ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন শ’ত-শ’ত মানুষের শনাক্ত ও মৃত্যু সরকারি হিসাবে আসছে না। সরকারি পরিসংখ্যানও বলছে, গ্রামে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে।
বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোয়াজ্জেম আলী খান বলেন, গ্রামের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এক শতাংশেরও কম মানুষ নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করছেন। হাট-বাজারে ভিড়ের মধ্যে চলছে কেনাকাটা। শারীরিক দূরত্ব একেবারেই মানা হয় না। এতে সূস্থ ব্যক্তিও তাদের সংস্পর্শে চলে যাচ্ছেন।
মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধ চলাফেরা করে নিরবে সংক্রমণ ঘটিয়ে চলেছেন বলে মন্তব্য করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তিনি আরো বলেন
করোনা পরীক্ষার পরিধি আরো বাড়াতে আমরা তৎপর রয়েছি।