পুরানো প্রাসাদ -সাকেরা বেগম শিমু

admin
  • আপডেট টাইম : আগস্ট ২৮ ২০২০, ১৯:১১
  • 1175 বার পঠিত
পুরানো প্রাসাদ -সাকেরা বেগম শিমু

দিত্বীয় পর্বঃ

তখন মাহিয়ার প্রেতাত্মা তার জীবিতকালের সেই অভিশপ্ত জীবনের কাহিনী বলতে শুরু করলো-“আজ থেকে দেড়শ বছর আগে এ পুরানো প্রাসাদ ছিলো ঝকঝকে তকতকে এক জমিদার মহল। আর আমি ছিলাম এই জমিদার মহলের সবচেয়ে সেরা নর্তকী। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় আমি নাচ-গান করে জমিদারের ছেলেদেরকে আনন্দ দিতে হতো। জমিদার ছিলেন তার বেগমকে নিয়ে ভীনদেশ ভ্রমণে। যাবার আগে তিনি তার ছোটছেলে তারেকুজ্জামান কে জমিদারি সামলাতে দিয়ে গেছেন কেননা তিনিও বুঝতেন উনার কোন ছেলে উপযুক্ত এ কাজের জন্য। এতে অপর দু ভাই কামরুজ্জামান ও আসাদুজ্জামান হিংসায় জ্বলে উঠে। তাদের কাউকে ভার না দিয়ে তাদের ছোটভাইকে দেয়া হয়েছে বলে। তারেকুজ্জামান জমিদারি পেয়ে প্রথমেই প্রাসাদের পাশে একটি বিরাট মসজিদ স্থাপন করেন। এর সাথে পাশের এলাকায় একটি হাসপাতাল ও তৈরি করান। এতে জমিদারির প্রায় অর্ধেকের ও বেশি খরচ হয়ে যায়। এটা দেখে বড় দু ভাই মিলে চক্রান্ত করে তারেককে মেরে ফেলবে বলে। ওরা ভাবে তারেক এভাবেই লোকসেবায় পুরো জমিদারিই বিলীন করে দেবে। এতে তাদের কোন চাহিদা আর পূরণ হবেনা। তারেকুজ্জামান আসরের শেষের দিকেই চলে যেতেন মসজিদে। সেখানেই তিনি রাতটা ইবাদতে পার করে ফিরে আসতেন পরদিন সকাল এগারটার দিকে। তাই তিনি কখনো আমাদের উপর করা জুলুম দেখতেই পেতেন না। যে জোর করে আমাদের উপভোগ করা হয়। নাচতে নাচতে যদি হাত পা মচকেও যায় তবে নাচ বন্ধ করলেই পড়তো চাবুকের বাড়ি। ফলে এই অত্যাচার এর মধ্যে থেকে একদিন রাতের অন্ধকারে সব নর্তকী একসাথে পালিয়ে যায়। শুধু আমি থেকে যাই। কেননা আমি প্রধান নর্তকী হওয়ার দরুণ আমাকে থাকতে হতো জমিদারের বড় ছেলে কামরুজ্জামানের খাস কামড়ায়। তার যখন ইচ্ছে হতো তখন আমাকে দিয়ে নাচ-গান করিয়ে সে আনন্দ লাভ করতো। আর এভাবেই আমার আর পালানো সম্ভব হয়নি।

তারপর! তারপর কি হলো মালিনী? মেহেদী কাঁপাসুরে জিজ্ঞেস করলো!
: তারপর সেদিন রাতে ঐ শয়তানটা আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ডেকে নিয়ে গেলো সেই নাচঘরে। আমার তখন ক্লান্তিতে খুবই ঘুম পাচ্ছিলো। কেননা সারাদিন নাচগান করে ওদের মনোরঞ্জন করতে করতে আমার শরীরটা খুব ধরে এসেছিলো। কিন্তু তবুও উপায় নেই। এই অবস্থায়ও ঐ জালিমটা আমাকে তুলে নিয়ে জোর করে ঐ পাপপুরীতে নিয়ে যায়। আর বলে-
“বাকি সবগুলো নর্তকী যখন পালিয়েছে তখন আজ সবগুলোর নাচ তুই একাই নাচবি। আর আমি সেটা প্রাণভরে উপভোগ করবো। আমি ছিলাম তখন অসহায়, কোন উপায় নেই পালাবার। কারণ শয়তান টা আগেই নাচঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ করে রেখেছিলো। তাছাড়া নাচঘর উপরের তলায় আর নিচের তলায় প্রধান ফটকের দরজায় রয়েছে তাদের নৈশ প্রহরী যেখানে আমি একটা মেয়ে নিতান্তই দুর্বল ও অক্ষম। অগত্যা আমি পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচতে শুরু করলাম। একে তো সারাদিনের ক্লান্তি তারউপর একসময় নৃত্যের মাঝখানে আমার পায়ের ঘুঙুর ছিড়ে এর ধারালো বোটাগুলো মেঝের চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। এমতাবস্থায় ও আমি এর উপর দিয়েই নাচতে থাকি। কেননা ও তা আমার পায়ের মধ্যে বিঁধে পা ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তার্ত করে দিলো। আমি যন্ত্রণার চোটে মাটিতে শুয়ে পড়ি। কোথায় আমার ক্ষতস্থানে কিছুটা হলেও প্রলেপ দেবে তা নয় উল্টো শয়তান কামরুজ্জামান টা হঠাৎ হিংস্র জানোয়ারের মতো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি প্রাণপন চিৎকার দিতে থাকি ‘কে আছো বাঁচাও আমাকে এই শয়তানের হাত থেকে’! কিন্তু পোড়া ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কেউই আমার সাহায্যে এগিয়ে আসলোনা! একপর্যায়ে আমি ওর হাতে কামড় বসিয়ে ক্ষত-বিক্ষত পা নিয়েই নাচঘর থেকে বেরিয়ে নিচের তলায় নেমে আসি। কিন্তু ইতিমধ্যে সে শয়তান বিশাল ঘণ্টা বাজিয়ে নৈশ প্রহরীদের জাগিয়ে দেয় ও আদেশ করে আমাকে যেন বাইরে যেতে না দেয়। ওরাও আমাকে তাড়া করে এগিয়ে আসছিলো এসময় আমি টেবিলে রাখা ফল কাটার ছুরি হাতে নিয়ে ওদের দুজনের বুকে বিঁধে দেই। ওরা তখনই মারা যায়। এরপর আমি দৌঁড়ে গিয়ে প্রাসাদের গেট টপকিয়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু এই জনশূন্য এলাকায় শুধুমাত্র জমিদারের ছোট ছেলে তারেকুজ্জামানের তৈরি ঐ জামায়া মসজিদ ছাড়া আর কিছুই ছিলোনা। অগত্যা আমি সেই মসজিদেই প্রবেশ করে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকি। আমার চিৎকারে মসজিদের ভিতরে থেকে কয়েকজন মুসল্লি দৌঁড়ে বেরিয়ে আসে। এরা প্রায় সারারাতই মসজিদে ইবাদত বন্দেগী করে ফযরের নামাযের পর বাড়ি ফিরে যায়। এদের মধ্যে ছিলেন এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা এই বংশের একমাত্র প্রজাদরদী ও দয়ালু শাসক জমিদারের ছোট ছেলে “তারেকুজ্জামান” ও।
তিনি আমাকে এ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন- “কে তুমি? আর এতোরাতে এখানে কি করছো”?
আমি উনাকে বললাম- আমি আপনার ভাইদের কেনা নর্তকী। ওরা আমাকে এক সওদাগরের কাছ থেকে একহাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনীময়ে কিনে নিয়েছে। ঐ শয়তান টা আমাকে আমার বাবার কাছে নিয়ে যাবে বলে ফুসলিয়ে এখানে এই জমিদারের প্রাসাদে নিয়ে আসে। আমার বাবা ছিলেন একজন মানসিক রোগী। তিনি এক নারী পাচারকারীর হাত থেকে একজন মহিলাকে বাঁচাতে গিয়ে ঐ পাচারকারীকে মেরে ফেললেও ওর হাতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। ঐ শয়তান বাবাকে মাথায় লাঠির বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। বাবা অজ্ঞান হয়ে গেলে তখন ঐ মহিলাই মানুষজন ডেকে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।চিকিৎসা শেষে ডাক্তার বলেন উনি ভালো হলেও মাথায় তীব্র আঘাত পাবার দরুণ উনার মাথায় মাঝেমধ্যে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে উনি পাগলের মতো আচরণও করতে পারেন। তখন যেন উনাকে আমরা দেখেশুনে রাখি। এইভাবে বাবা মাঝেমধ্যে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতেন। সেদিনও তাই হয়েছিলো। তবে ডাক্তার যেহেতু বলেছিলো উনার প্রয়োজন শুধু সেবা-যত্ন আর ভালোবাসা তাই চাচারা আর নতুন করে এতে তেমন পাত্তা দেয়নি। ওদের দায়িত্ব হয়তো ছিলো শুধু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। ওদের বউরা এতেই ওদের বলতো- ভাইয়ের চামচা। তাই সেদিন বাবা পালিয়ে গেলে দুই চাচা বললো- ‘ওর বউ না থাকলেও দুটি মেয়ে তো আছে। ওরাই ওকে দেখে শুনে নিয়ে আসবে।’
সেখানে তাদের সাথে এক অপরিচিত বৃদ্ধলোক ছিলো। সে নাকি ব্যবসার বিষয়ে কথা বলতে আমার চাচার কাছে এসেছে। চাচারা যাচ্ছেনা দেখে আমার ছোট বোনকে ঘরে থাকতে বলে আমিই তখন বাবার খোঁজে রাস্তা দিয়ে হাটছি। এমন সময় সেই বৃদ্ধলোকটি এসে আমাকে বলে –
‘আমি জানি তোমার বাবা এখন কোথায়। যদি উনাকে ফিরিয়ে আনতে চাও তবে আমার সাথে এসো।’
আমি আর কিছু না ভেবে পাগলের মতো উনার পিছু ছুটতে থাকি। কতক্ষণ এভাবে ছুটেছি বলতে পারবোনা। যখন আমার হুঁশ হলো তখন দেখলাম আমি এক বিশাল প্রাসাদের ভিতর পৌঁছে গেছি! সেখানে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক লম্বা চওড়া কাধের বিশালদেহী লোক। যিনি অন্য কেউ নন আপনারই বড়ভাই কামরুজ্জামান। তিনি তখন ঐ বৃদ্ধকে একথলি মোহর দিয়ে আমাকে কিনে নেন। তখন লোকটি বলে এখন থেকে তুমি আর ভাঙাঘরে না থেকে এই রাজপ্রাসাদেই থাকবে। বলে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো।

তখন থেকেই শুরু হয় আমার অভিশপ্ত বন্দী জীবন। আমার মতো আরো কয়েকজন মেয়েও ছিলো এই অভিশপ্ত জগতের বাসিন্দা। সে ওদের দিয়ে প্রাসাদে নাচ-গান করাতো। আমাকেও সে ঐ একই কাজে লাগিয়ে দেয়। আমি অন্যদের চেয়ে রূপসী থাকায় সে আমাকে তার ই কামড়ায় একটি ছোট খাটে থাকতে বলে। আমি বাঁধা দিয়েও কোন লাভ হয়নি। কেননা আমি যে তার কেনা দাসী। অন্য কেউই আমার কষ্টটা বুঝতে চায়নি। এখানে আসাটাও যে আমার অজান্তেই ঘটেছে সেটাও কেউ শুনতে চায়নি। শুধুমাত্র ঐ ভোক্তভোগী মেয়েরা ছাড়া। তাই তারা অনেকদিন ধরে বুদ্ধি আটছিলো কিভাবে এই নরক থেকে মুক্তি পাবে। সে অনুযায়ী কাল তারা সবাই একত্রে পালিয়ে গেছে শুধু আমি ছাড়া। কারণ, আমাকে তো থাকতে হতো আপনার ভাইয়ের কামরায়! তিনি রাত-বিরাতে আমাকে দিয়ে নৃত্য করিয়ে আনন্দ-বিনোদন করতেন।এতেও উনি ক্ষান্ত হননি। আজ আপনার ভাই জোর করে আমার সতীত্ব হরণ করতে চেয়েছিলেন, তাই আমি কোনমতে প্রাণ নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছি।

অবস্থা বেগতিক দেখে বাকি মুসল্লিরা মসজিদের গেইট বন্ধ করে দিলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম-” আপনি এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও একজন প্রজাদরদী আল্লাহর খাস বান্দা। আর সেই আপনারই বড়ভাই এরকম নারীলোভী মদ্যপ চরিত্রহীন হবে এটা বিশ্বাস করতেও আমার কষ্ট হয়।

উনি লজ্জিত হয়ে আমাকে অভয় দিয়ে বললেন-“তুমি ভয় পেওনা বোন। অন্তত আমি বেঁচে থাকতে শুধু আমার ভাই কেন, পৃথিবীর কেউই তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। আমার জানা ছিলোনা আমার অগোচরে ভাইরা আমাদের স্বপ্নের এই প্রাসাদটাকে একটি পিশাচপুরী বানিয়ে রেখেছে!

ইতিমধ্যে পিশাচ কামরুজ্জামান মসজিদের দেয়াল টপকে লাফ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। তার হাতে মদের বোতল। সে মাতাল অবস্থায় ঢুলতে ঢুলতে তারেকুজ্জামান কে চিৎকার দিয়ে বললো- “তারেক! তুই ঐ মেয়েকে এক্ষুণি আমার হাতে তুলে দে।
“-না ভাইজান। তুমি যে এতো নীচ ও পশুস্বভাবের হতে পারবে তা আমার কল্পনারও অতীত ছিলো! একটি নিষ্পাপ অবলা মেয়েকে দিনের পর দিন তোমার দৃষ্টির ভোগ ও বিনোদনের সামগ্রী বানিয়ে এসেছো! আর আজ তুমি পশুত্বের সীমা ছাড়িয়ে ওর সতীত্ব নষ্ট করতে চাইছো! জানো না – মেয়েদের ইজ্জত তার আল্লাহর দেয়া অমূল্য সম্পদ?এটা শুধুমাত্র তাদের স্বামীর জন্য রক্ষিত আমানত। এতে হাত দেয়ার অধিকার অন্য কোন পুরূষের নেই। তুমি যদি একান্ত মেয়েটাকে ভোগ করতেই চাও তাহলে তাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলে নিচ্ছো না কেন?

তারেকুজ্জামানের কথা শুনে কামরুজ্জামান বাঘের মতো হুংকার দিয়ে বললো- “ওর মতো ভিখারীনিকে বিয়ে করবো আমি! হাহ্! ও শুধু আমার ভোগের সামগ্রী বুঝলে? ওর উপর আমার অধিকার আছে কিন্তু আমার উপর ওর কোন অধিকার নেই। ও হচ্ছে আমার কেনা দাসী। এতোদিন আমি শুধু ওর নাচ দেখে আর গান শুনে আনন্দ লাভ করেছি। আজ আমি ওর যৌবনের সুধা পান করে আমার এতোদিনের তৃষ্ণা মেটাবো। আমি যখন ওকে কিনে নিয়েছি তখন ওর সবকিছুর মালিক ই আমি। দে তারেক, ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দে!

-“কখ্খনো না ভাইজান। তুমি ওকে যার কাছ থেকে কিনে নিয়েছো সে ওর সঙ্গে প্রতারণা করে এখানে নিয়ে এসে তোমার কাছে বিক্রি করেছে। যার সাজা সে এতোদিন ভোগ করে এসেছিলো। কিন্তু আর না! ও যখন স্বেচ্ছায় বিক্রিত হয়নি তখন ওর ইজ্জতে হাত দেবার কোন অধিকার তোমার নেই। তুমি এক্ষুণি এই মসজিদের সীমানা থেকে, এই পবিত্র স্থান থেকে বেরিয়ে যাও।

-“না, আমি একলা যাবো না। তুই ঐ মেয়েকে আমার হাতে তুলে দে। ওকে নিয়েই আমি এখান থেকে যাবো। দে বলছি ওকে আমার কাছে!

-“আমি বেঁচে থাকতে ওটা কখনোই হবে না।

তারেকুজ্জামানের এই কথায় ঐ পিশাচটা ক্ষেপে গিয়ে বলে- ‘তবে তুই ই আগে মর্, বলে তার হাতের মদের বোতলটা ছুড়ে মারে তারেকুজ্জামানের কপাল লক্ষ্য করে!

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর