পুরানো প্রাসাদ –শাকেরা বেগম শিমু

admin
  • আপডেট টাইম : আগস্ট ২৮ ২০২০, ১৯:০৭
  • 1220 বার পঠিত
পুরানো প্রাসাদ –শাকেরা বেগম শিমু

ভৌতিক উপন্যাস
প্রথম পর্ব:
নাদিয়া, মারিয়া, জাকিয়া, পাপিয়া ওরা চার বান্ধবী।সবাই মিলে খাদিমবাড়ির বটতলায় বসে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। এদিকে জান্নাত, মেহেদী, খালেদ, ও সাদিকের কোন পাত্তাই নেই। কাল কথা হয়েছিল বিকাল চারটায় সবাই এখানে এসে একত্রিত হবে। কারণ জান্নাত ওদেরকে তাদের গ্রামের শেষ সীমানায় দু’শো বছরের পুরানো জমিদার বাড়িটি দেখাবে বলেছে। বাড়ি না বলে ওটাকে একটা প্রাসাদ বলাই ভালো কারণ ওই দালানের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তটা খালি চোখে স্পষ্ট দেখাই যায়না। প্রাসাদটা লম্বায় ছিল আট মাইল ও চওড়া ছিল চার মাইল পর্যন্ত। এমন একটা প্রাসাদ যে জান্নাতদের এলাকায় আছে তা দেখার জন্য সবাই আজ দুদিন হলো মণিপুরে এসেছে। এখানে সবারই নিজস্ব আত্মীয়দের বাড়ি থাকায় কাউকে আর জান্নাতদের বাড়ি কিংবা কোন সরাইখানায় থাকতে হয়নি। আগেরদিন অবশ্য সবার কাছ থেকে সে জেনেছিলো যে ওরা তাদের আত্মীয়দের এ প্রাসাদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সবাই একই উত্তর দেয়-“ওই ভয়ানক ভূতুড়ে প্রাসাদের ধারে-কাছেও কেউ যায়না ভয়ে। এমনকি ঐ প্রাসাদের কথাও ভয়ে মুখে আনেনা। সেজন্যই তাদের কাউকে কোনদিন ওসব কথা কেউই জানায়নি আর এটাই স্বাভাবিক।”
এরপর তারা আর কথা বাড়ায়নি।

আজ এতোক্ষণ অপেক্ষা কথার পর প্রায় পৌঁনে পাঁচটার দিকে মেহেদীরা একে একে সবাই বটতলায় এসে হাজির হলো।
নাদিয়ারা প্রায় সমস্বরে জানতে চাইলো-‘কি রে তোদের আসতে এতো দেরি হলো কেন হাহ্? সেই কখন থেকে আমরা এখানে বসে বসে কোমরে ব্যাথা হয়ে গেল!’

জান্নাত-‘আরে এখনো তো জমিদার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম ই না। এরই মধ্যে কোমরে ব্যাথা হলে চলবে?’

নাদিয়া-‘সেকি! এখন তো প্রায় সন্ধ্যা এসেই পড়লো। এখন যাবে ঐ ভূতুরে পুরানো প্রাসাদে? না বাবা আজ আর গিয়ে কাজ নেই। তারচে’ চল্ আজ আমরা সবাই মিলে প্রাসাদের উত্তর দিকের বিশাল “পরীর দিঘী”টা দেখে আসি।’

জান্নাত -‘আরে পাগলি, ঐ পুরানো প্রাসাদে কি আর দিনে যাবো নাকি? সেখানে তো যাবোই রাত্রিবেলা। আসার সময় ছোটমসজিদ থেকে আসরের নামাযটা পড়ে এসেছি তাই আসতে একটু দেরিতো হবেই। তাছাড়া ভূতের বাড়িতে নিশিতে না গেলে কি ভালো দেখায় বল্?’

মারিয়া-‘আমরা তো বাসা থেকেই আসরের নামায পড়ে অনেক আগেই এসে পড়েছি। আর এখন তুই বলছিস ওখানে যাবোই একেবারে সন্ধ্যার পরে! ওরে বাবা! শুনে আমার এখনই গা টা কেমন যেন ছমছম করছে। রাতের বেলা ওখানে গেলে আবার অনাকাঙ্খিত কিছু হবেনাতো? বাবারে !!

মেহেদী-‘আচ্ছা তোরা এতো ভীতুর ডিম কেন বলতো? এখনো যাওয়াই হয়নি তার আগেই ম্যাডামরা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে।’

জাকিয়া-‘আচ্ছা বল এখন কি করতে হবে?’
খালেদ-‘কি আর করা? সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত এখানেই বসে থাকতে হবে।’
পাপিয়া-‘একেবারে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত! এমনিতেই এতোসময় অপেক্ষা করে কোমরে ব্যাথা হয়ে গেলো তার উপর আরো এতোক্ষণ ধরে বসে থাকলে তো পায়ে খিলই ধরে যাবে!’

সাদিক-‘এই তোকে কে বললো রে বসে থাকতে? যা না খোলা মাঠে একটা দৌঁড় লাগা। এতে কিছুটা শরীরচর্চাও হয়ে যাবে সাথে ভুটকির কোমরের ব্যাথাটাও সেরে যাবে।’

সাদিকের কথা শুনে সবাই মিলে একসঙ্গে হেসে উঠে। পাপিয়া আর কথা না বাড়িয়ে গাছতলায় বসে পড়ে।
———-
মাগরিবের আযানের পর ওরা সবাই মিলে জামায়া মসজিদে গিয়ে নামায পড়লো। এই মসজিদটির অবস্থান আবার ঐ পুরানো প্রাসাদের পাশেই। শুনা যায় বহুকাল আগে নাকি জমিদারের ছোটছেলে এ বিশাল মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। যেখানে নারী-পুরূষ উভয়েই নামায পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। জমিদার বংশের অন্যরা স্বভাবগতভাবে হিংস্র ও নারীলোভী হলেও এই একজনই কেবল দয়ালু, প্রজাদরদী ও ধার্মিকমনা শাসক ছিলেন। জমিদার বংশের বাকি সবার মৃতদেহ কিংবা কবর সম্পর্কে কেউ ওয়াকিবহাল না থাকলেও জমিদারের ছোটছেলে শাহ তারেকউজ্জামানের কবর এই মসজিদের ভিতরেই। লোকেরা এখনো প্রতিবার নামাযের পর তার কবর যিয়ারত করে যায়।

ওরা সবাই মসজিদ থেকে বেরোনোর পর ছেলেরা একটা করে টর্চলাইট হাতে নিলো ও মেয়েরা তাদের মোবাইলের ফ্লাশলাইট অন করে পা টিপে টিপে জমিদার বাড়ির মাঁকড়শার জাল ভর্তি গেটটি ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললো। গেটটি খুলতে খুলতে গাড়ির হর্নের মতো অদ্ভুত শব্দ করছিলো! বুঝাই যাচ্ছিলো গেটটি বহুকাল থেকে খুলা হয়নি। তারা সন্তর্পনে ভিতরে প্রবেশ করে প্রাসাদের আঙিনায় এসে দাঁড়ালো।

-‘বাহরে! কি বিশাল আঙিনা!এটা অনায়াসে একটা ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।’ সাদিক ফিসফিসিয়ে বললো।

জান্নাত-‘হুম, সাথে দেখ কি সুন্দর মধুপূর্ণিমার চাঁদনী! এখন চল আর দেরি না করে প্রাসাদের ভিতরে ঢুকে যাই।’

মারিয়া-‘হ্যাঁ চল। এখানেতো চাঁদের আলোতে সবকিছু ভালোই দেখা যাচ্ছে। জানিনা ভিতরের অবস্থা কেমন হবে?’

ওরা আর কথা না বাড়িয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই তারা নাকে একটা উৎকট দুর্গন্ধ পায়! মনে হচ্ছিলো যেন মানুষ পচার গন্ধ এটা। কিন্তু গন্ধের উৎসটা কোথায় তারা কেউই ঠাহর করতে পারলো না। প্রাসাদের ভিতরটাও এখন ইঁদুর-ছুঁচো-ব্যাঙ-মাঁকড়শা ও নানা কীটপতঙ্গের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। যেখানে পা ফেলে ঠিকভাবে চলার মতো অবস্থা নেই। একে তো চারদিকে মাঁকড়শারা তাদের রাজত্ব বিস্তার করে বসে আছে তার উপর বড় বড় ইঁদুর ছুঁচো মাঝেমধ্যেই পায়ের নিচে পড়ে যাচ্ছে। নাদিয়া তো একবার একটি ইঁদুরের লেজে পা রাখতেই ইঁদুরটি তার পায়ে এক কামড় বসিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়। নাদিয়া ভয়ে আকাশ ফাটানো চিৎকার দিয়ে মেহেদীর ঘাড়ে চড়ে বসে।-“ও মাগো, আমাকে মেরে ফেললে গোওও” বলে।
ঘাড়ে ভারী কিছু অনুভব করে ঘাবড়ে গিয়ে মেহেদীও বড়গলায় চেঁচিয়ে উঠে।

-‘ও আল্লাহ রেএএ; দিলো আমার ঘাড়ের বারটা বাজিয়ে! এতো সাপ-ব্যাঙ-কাঠবিড়ালী থাকতে শেষে কিনা আমার কাধে পড়তেই তোর ইচ্ছে হলো। বাব্বাহ, কি ভারী রে বাবা। মনে হয়েছে একটি হাতী আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে।’

তাদের দুজনের চেঁচামেচি শুনে জান্নাত রেগে এক ধমকে ওদের থামিয়ে দিলো।
-‘এই তোরা থামবে কি! শালা এসেছিস ভূতের রহস্যের মীমাংসা করতে আর এসে এই সামান্য ইঁদুর ছুঁচোর ভয়ে যা শুরু করেছিস না, মনে হচ্ছে তোদের না এনে আমি একা আসলেই ভালো হতো। এবার চুপ করে এগিয়ে আয় তো?’

খালেদ একটি লাঠি সংগ্রহ করে তা দিয়ে মাঁকড়শার জালগুলো কেটে কেটে পথ বের করতে লাগলো। তারা বড় বড় দুটি কামড়া পেরিয়ে আসার পরে মেয়েলী গলায় কারো ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়! মনে হচ্ছিলো কে যেন মার খেয়ে এখানে এসে লুকিয়ে বসে কাঁদছে! সেই শীতল কণ্ঠের কান্নার সুর শুনে ওদের সবার শিঁড়দাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে নেমে গেলো! তারা একে অন্যের হাত শক্ত করে ধরে রেখে সেখানে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগতো। আওয়াজটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে আসছে। ওরা চতুর্দিকে টর্চ ও মোবাইলের ফ্লাশ লাইট মেরে খুঁজতে লাগলো কাঁদার উৎসটা কি। কিন্তু কোনদিকে কিছুই দেখতে না পেয়ে তারা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু তারা যতোই দূরে যাকনা কেন কাঁদার শব্দটা সেই একই আওয়াজ এ তাদের কানে ভেসে আসতে লাগলো! যেন কান্নার উৎসটাও তাদের সঙ্গেই হেঁটে আসছে!
নাদিয়া ভয়ে ভয়ে বলে- “জান্নাত রে, আমার পা টা আর সামনে চলছে না রে! মনে হচ্ছে পায়ের সঙ্গে কেউ দশমণ ওজনের পাথর বেঁধে দিয়েছে।”

ওকে এক ধমকে থামিয়ে দিলো সাদিক। বললো –
‘তোর যদি এমন ভীতুর প্রাণ তো আসলে কেন এই ভূতুড়ে প্রাসাদে? এখন কি আমরা তোকে কোলে নিয়ে হাঁটবো নাকি? আমারই বুকটা কেমন ধড়ফড় করছে ঐ করুণ কান্নার আওয়াজ শুনে! এখন তোর পা পঙ্গু হয়ে গেলে তুই এখানেই বসে পড়্।’

তাদের কথা বলার একপর্যায়ে পাশের ঘরে ধপাস করে কিছু পড়ার শব্দ হলো আর সাথে সাথে শুনা গেলো বিকট আর্তচিৎকার। ওরা সবাই ভয়ে দুরূদুরূ করে কেঁপে উঠলো! মনে মনে আল্লাহর নাম ও বিভিন্ন দোয়া দুরূদ জপ করতে করতে তাড়াতাড়ি ওরা আগত শব্দের দিকে এগিয়ে গেলো-কি এতো বিশাল জিনিস এখানে পড়লো আর চিৎকারটাই বা কে করলো তা দেখার জন্য! কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা ধুলোবালি ও মাঁকড়শার জাল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলনা।

জাকিয়া বললো-‘আরে শব্দটাতো এদিকেই হলো তাই না?এখন তো দেখছি এটা আগের মতোই মাঁকড়শার জালে ভর্তি! কাঠের বাক্সের মতো লম্বা কি যেন একটা ধুলোবালিতে ভর্তি বলে ঠিকমতো দেখাও যাচ্ছেনা। তাহলে এতো ভারী কি এসে পড়লো এখানে আর কে-ই বা এতো বিটকস্বরে চিৎকার দিলো?’

ততক্ষণে ওরা সবাই বুঝে গেলো এটা স্বাভাবিক কিছু নয়। এটা সম্পূর্ণ ভৌতিক ব্যাপার। তাদের সবার মনে এক চাপা ভয় ও অস্বস্থি জেগে উঠলো! এখন কি করবে তারা? এখান থেকে দৌঁড়ে চলে যাবে নাকি এই অদ্ভুত ভূতুড়ে রহস্যের একটা মীমাংসা করবে!

পাপিয়া ভয়ে ভয়ে বলেই ফেললো-‘চল আর এখানে থেকে কাজ নেই। ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে আসছে। এখন এখান থেকে মানে মানে কেটে পড়ি।’

খালেদ-‘না পাপিয়া! এখন আর তা সম্ভব নয়। আমাদের অবশ্যই জানতে হবে এই ভৌতিক কর্মকান্ডের মূল হেতুটা কি! কে করছে এসব! সে আসলে কি চায়? এই সবকিছু আমাদের জানতেই হবে।’

জান্নাত -‘হ্যাঁ খালেদ ঠিক কথাই বলেছে। একবার যখন এ রহস্যের মধ্যে আমরা ঢুকে পড়েছি, তখন এর কীনারা না করে আর যাচ্ছিনা এখান থেকে। কি বলিস তোরা?’

সাথে সাথে মেহেদী ও সাদিক তার কথায় সুর মেলালো- “অবশ্যই। আমরা এ ভৌতিক রহস্যের কীনারা করে তবেই এ পুরানো প্রাসাদ থেকে বের হবো, তার আগে নয়।”

পাপিয়া বললো-‘নিচে তো অনেকক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটি করছি, এবার চল উপরে কি আছে গিয়ে দেখে আসি।’

ওরাও সম্মত হলো। মারিয়া বললো-‘বেশ তবে চল।’

ওরা পুরোনো দিনের ধুলোয় ভরা বড় বড় সিড়ি মাড়িয়ে উপরে চলে এলো। তারা দেখলো প্রাসাদটি পুরানো হলেও কিন্তু বেশ মজবুদ। ভালোমত ধুয়েমুছে রং করা গেলে এটাকে একটা সুন্দর জাদুঘর বা এতিমখানায় পরিণত করা যেত। কিন্তু এখন যে এটা ভূতের মানে অশরীরীদের আবাসস্থল! আগে তো এটা থেকে ওরা নিজেদেরকে ও সেই প্রাসাদটিকে মুক্ত করতে হবে। আদৌ তারা সেটা করতে পারবে কিনা কেউ জানেনা। নাকি তারাই সবার অজান্তে এই ভূতুরে প্রাসাদে চিরদিনের মতো বিলীন হয়ে যাবে! ! !

আচমকা জাকিয়ার চিৎকার শুনে সবাই পিছনে ফিরে তাকায়!
‘ক্ক-কি হয়েছে এই? এতো চেঁচাচ্ছিস কেন?’
মেহেদী অনেকটা কাঁপাগলায় জিজ্ঞেস করলো। জাকিয়া কিছু না বলে শুধু সামনের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করলো। সবাই তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে প্রায় সকলেই একেবারে সমস্বরে মরণ চিৎকার দিয়ে উঠলো!
সামনে দাঁড়িয়ে আছে বীভৎস চেহারার এক নারীমুর্তি! মাথা ও মুখে রক্তের দাগ, গলা দিয়ে বেয়ে বেয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে! চুলগুলো জঙ্গলের মতো জটা পাকিয়ে আছে! পায়ের গোড়ালী দুটো উল্টোদিকে ঘুরানো! ক্রুদ্ধচোখে তাদের দিকে তাকিয়ে ওটা ফুঁসছে !যেন এক্ষুণি তাদের চিঁবিয়ে খাবে।
ওরা জড়সড় হয়ে পুরানো প্রাসাদের এককোণে এসে দাঁড়ালো যেন ওখানেই কোন দরজা আছে সেটা দিয়েই টুপ করেই বেরিয়ে যাবে তারা।
কিছুক্ষণ কেউই কোন কথা বললো না। অবশেষে জান্নাত নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলো-‘কে তুমি? কি চাও তুমি?’

উত্তরে আকাশ-বাতাস ফাটানো ভয়ংকর হাসিতে সমস্ত প্রাসাদ যেন কেঁপে উঠলো। সেই নারীমুর্তি টি বললো-
‘আমি “মাহিয়া মালিনী”, চাই তোমাদের মৃত্যু, সবার মৃত্যু। হা হা হা’
বলে আবারো সে ভয়ানক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।

মারিয়া বললো-‘কিন্তু কেন তুমি আমাদের মারতে চাও। আমরা তোমার কি ক্ষতি করেছি? বলো?’

‘ক্ষতি তোমরা করোনি, করেছে তোমাদের পূর্বপুরূষেরা। তোমাদের মধ্যেই একজন ওর বংশধর। তাই তোমাদের সবাইকেই মেরে আমি আমার এতো বছরের অপমানের, নিষ্ঠুরতার, ও হিংস্রতার বদলা নেবো।’
বলে সে রাগে আবারো ফুঁসতে লাগলো। ওর গাঁ থেকে একপ্রকার বিশ্রি দুর্গন্ধ তাদের নাকে আসতে লাগলো। হঠাৎ তাদের খেয়াল হলো প্রাসাদে ঢোকার পর এমনই একটা উৎকট বিকট দুর্গন্ধই তারা টের পেয়েছিলো! তার মানে সেটা এই মেয়েটির মানে এই ‘মেয়ে-প্রেতাত্মা’ টির গায়ের গন্ধ ছিলো! ওরা ইতিমধ্যে বুঝে গেছে কিসের পাল্লায় তারা পড়েছে! ঐ নারী প্রেতাত্মাটির ক্রুধের বলি হতে হবে আজ তাদেরকে। কিন্তু এখানে তাদের কেন বিনাদোষে শাস্তি পেতে হচ্ছে সেটাই কারো মাথায় আসছেনা। সাদিক একটু ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো-

‘কিন্তু বন্ধু তোমার আমাদের উপর এতো আক্রোশ কেন? তুমি যখন মারা যাও তখন তো আমাদের কারো জন্মও হয়নি।তাহলে এখানে আমাদের অপরাধটা কি বলো? আর মারা গেলে তো সবাই এ জগৎ থেকে অন্য জগতে চলে যায়, তাহলে তুমি কেন এখনো পৃথিবীতে এই অভিশপ্ত অবস্থায় এ পুরানো প্রাসাদে বন্দি? বলো বন্ধু? আমরা কি কোনভাবে তোমাকে এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিতে পারি? যদি তেমন কোন পথ থাকে তবে আমরা অবশ্যই তোমার জন্য তা করবো।

সাদিকের কথা শুনে “মাহিয়া মালিনী”র আত্মা যেন ডুকরে কেঁদে উঠলো। বললো-
‘আমি কিভাবে আমাদের জগতে যাবো। এই দেড়শ বছর থেকে যে এখনো আমার লাশের জানাযা কিংবা দাফন কোনটাই হয়নি? তাই আমার অতৃপ্ত আত্মা অভিশপ্ত হয়ে এই পুরানো প্রাসাদের আনাচে কানাচে এখনো ঘুরে বেড়ায়। এ পর্যন্ত বাইশ জন পুরূষকে আমার হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। কারণ, ঐ পুরূষ জাতি কোন মানুষ নয় ওরা হলো নারীলোভী রাক্ষস। ওরা আমার মৃত্যুর পরও আমার লাশটাকে পর্যন্ত ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে। আমার প্রাণহীন শরীরটাও ওদের মতো রাক্ষসদের কবল থেকে বাঁচতে পারেনি। শেষে যখন লাশ পচে গন্ধ বেরিয়েছে তখন আমাকে বস্তাবন্দী করে এই কাঠের বাক্সে ভরে এখানে রেখে দিয়েছে। বাইরে নিয়ে সমাহিত ও করেনি কেননা এতে প্রজারা বিশেষ করে তাদের ছোটভাই এসব দেখে ফেলার ভয় আছে, তাই। এসব মানুষরূপী জানোয়ারদের জন্য দেড়শ বছর ধরে আমার লাশ এই প্রাসাদের কোণে কাঠের বাক্সে বন্দী। এখন এই বাক্সেও ঘুণ ধরে গেছে।মানুষে খাবার পরে পোকামাকড় রা খুঁটেখুঁটে খেয়েছে আমার দেহটাকে। যে বাইশজন পুরূষ আমার জন্য প্রাণ হারিয়েছে তাদের শুধুমাত্র সাতজনকে আমি নিজে মেরেছিলাম। কেননা ঐ সাতজন ও ছিলো ঠিক ওদের মতোই নারীলোভী শয়তান।ওরাও এই প্রাসাদে জোর করে মেয়েদের তুলে নিয়ে এসেছিলো কেউ একজনকে কেউ আবার একাধিক মেয়েকে। তখনই আমার অতৃপ্ত আত্মায় প্রতিহিংসার আর প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠে। আমি ওদের সবার ঘাড় মটকে পরীর দীঘিতে ওদের লাশ ফেলে দিই। আমার জন্য সেই অবলা মেয়েগুলো বেঁচে যায়। আর বাকিদের আমি নিজে মারিনি। ওদের আমি বলতে চেয়েছিলাম আমার লাশের যেন জানাযা পড়িয়ে দাফন করা হয়, কিন্তু ওরা আমার ভয়ংকর স্বরূপ প্রেতাত্মা কে দেখে ভয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সেখানেই মারা যায়। পরদিন লোকেরা তাদের লাশ এখান থেকে নিয়ে যায়। কিন্তু আমার কঙ্কাল হয়ে যাওয়া বাক্সবন্দী লাশটাকে কারো নজরে পড়েনি। বলে মাহিয়া রাগে ফুঁসতে থাকে। তার চোখ দুটো বেয়ে অশ্রুর মতো আগুন ঠিকরে বেরুয়!!

“মাহিয়া মালিনী”র কথা শুনে ওরা সবাই বিস্ময়ে আশ্চর্য্যে স্তব্ধ হয়ে অনেকক্ষণ বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর জান্নাত তাকে বললো- “আমরা কি তোমাকে কোনভাবেই সাহায্য করতে পারিনা? সত্যি বলতে তোমার এ করুণ কাহিনী শুনে আমাদেরও খুব খারাপ লাগছে মাহিয়া। তুমি যদি চাও তবে আমরা সসম্মানে তোমার লাশের জানাযা পড়িয়ে সমাহিত করতে পারি। তবে তার আগে তোমাকে আরো কিছু কথা বলতে হবে, মানে আমাদের জানাতে হবে।
মাহিয়া বললো-“তোমরা আর কি কথা জানতে চাও?”
মেহেদী বললো-‘তোমার জীবতাবস্থায় থাকাকালের ঘটনা থেকে শুরু করে তুমি কিভাবে মারা গেলে, কে বা কারা তোমাকে মেরেছে, কে তোমার লাশকে এখানে বাক্সেবন্দী করে রেখেছে, তাদের শেষে কি পরিণতি হয়েছিলো, এবং এ প্রাসাদে তুমি ছাড়া কি আর কোন প্রেতাত্মা আছে বা নেই, এই সবকিছু আমরা জানতে চাই। এগুলো আমাদের জানা প্রয়োজন।’
মেহেদীর সাথে বাকি সবাইও সমস্বরে বলে উঠলো-
হ্যাঁ হ্যাঁ এই সবকিছু আমাদের জানতেই হবে।

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর