পুরানো প্রাসাদ —–শাকেরা বেগম (শিমু)

admin
  • আপডেট টাইম : আগস্ট ২৮ ২০২০, ১৯:১৬
  • 1441 বার পঠিত
পুরানো প্রাসাদ —–শাকেরা বেগম (শিমু)

(চতুর্থ পর্ব)

রাজনগর থেকে আসাদের শ্বশুরবাড়ির খাস চাকর কামরান পটু জমিদার মহলে আসে আসাদকে নেয়ার জন্য। মাত্র একঘণ্টা আগেই সে তার প্রাসাদে পা রাখলো এরই মধ্যে আবার তাকে চলে যেতে হচ্ছে। কারণটা অবশ্য গুরূতর। তার স্ত্রী নাকি ছাদে পায়চারি করতে গিয়ে কোন ফাঁকে পা পিছলে শানদার একফুট উঁচু রেলিং টপকে নিচে পড়ে গেছে! এখন ওর অবস্থা খুব আশংকাজনক। বাঁচে কি না তাই সন্দেহ। সেজন্য তার শ্বশুর বদ্যি ডাকার সাথে সাথে আসাদুজ্জামান কেও ডেকে পাঠিয়েছেন। আসাদের আবার ওখানে যাবার একটি কূট-নীতি ছিলো। তাকে প্রতিবারই শ্বশুরবাড়ি যেতে বউয়ের জন্য স্বর্ণের কোন না কোন অলংকার নিয়ে যেতে হতো। আজ সে এই ভেবে কিছুটা খুশি হলো যে এখন অন্তত সাথে কোন অলংকার না নিলেও চলবে। কারণ যে তাকে শাসাবে সে তো এখন জীবন-মৃত্যুর সন্দীক্ষণে। তাই তার আর চিন্তা কি? সত্যি বলতে সে তার শ্বশুরবাড়িকে কিন্তু শ্বশুরের বাড়ি হিসেবে পায়নি, পেয়েছে অসুরের বাড়ি হিসেবে! যেমন জেদি বউ তেমনি তেজি শ্বাশুরী। যদিও বিয়ের পর তার শ্বশুরমশায় তাকে দশবিঘা ধানজমি ও একটি বড় ফলের বাগান উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু বাকিদের বেলায় সে একজন ছোটখাটো এমপ্লয়ারের মতো। একদিকে লোভি-জেদি বউ আরেকদিকে রাগী-তেজি শ্বাশুরী। দু’জনের মাঝখানে থেকে আসাদের অবস্থা অনেকটা শীল-পাটার মাঝে বাটা মশলার মতো হয়ে যায়। তবু শ্বশুরের মন রাখতে ও নানান রকমারী ভোজন করতে আসাদ বছরের অর্ধেক সময়ই রাজনগরে তার শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে দেয়। আজ সে যখন নিজের প্রাসাদে ফিরে আসলো তার একঘণ্টা পরই আবার সেই শ্বশুর না অসুরবাড়িতে চলে যেতে হচ্ছে। যখন সে কামরানকে নিয়ে রাজনগর পৌঁছালো তখন সমস্ত মহল জুড়ে ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরূষ সবার কান্নার আওয়াজে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছিলো। সে এর কারণটা আন্দাজ করে দৌঁড়ে তার বউয়ের কামরায় গিয়ে দেখে চার মিনিট আগেই তার জেদি বউ গত হয়েছেন। এটা দেখে আসাদ প্রথমে অনেকটা ঘাবড়ে গেলো। এটি তার জন্য দুঃসংবাদ না সুসংবাদ এটা বুঝতে তার একটু বেগ পেতে হলো। পরক্ষণেই সে চিৎকার দিয়ে লোকদেখানো কান্না জুড়ে দিলো। সবাই মিলে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। এরইমধ্যে তার চোখ গেলো তার তেরো বছরের শালিকার দিকে! যে এখানে বসেই একমনে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। কেউ কেউ তাকেও সান্ত্বনা দিচ্ছে। এতোদিন সে তার শালিকা কে ঠিকমতো দেখতেই পারেনি। কারণ যে কালনাগিনী তার সঙ্গে থাকে তার কড়া শুনানী – “আমি ছাড়া অন্য কারো দিকে তাকালে চোখ উপড়ে নেবো”। সেই কারণেই এতোদিন সে চুপ মেরে ছিলো। কিন্তু আর নয়। এখন সে আর দেরি করবেনা। শীঘ্রই সে তার শ্বাশুরীর কাছে তের বছরের কুমারী এলিনা কে বিয়ে করার প্রস্তাব দেবে। হ্যাঁ, শীঘ্রই!
——
কামরুর আত্মার মাগফেরাত কামনার পর থেকে আর কাউকে অপঘাতে মরতে হয়নি। এই ভেবে এলাকার সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো যে আর কোন ভয় নেই, এখন সবাই শান্তিতে থাকতে পারবে। কিন্তু না! ওরা কেউ তখনো জানতো না যে ভবিষ্যতে তাদের কপালে কি দুর্বিষহ কষ্ট রয়েছে। এদিকে দু সপ্তাহ আগেই তাদের জমিদার শাহ তারেকুজ্জামান মশায় মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে সুদূর আরবদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এখন তাদের মাথার উপর আর নেই কারো ছায়া।।

আসাদ তার স্ত্রীর কাফন-দাফন সম্পন্ন করে বিরষ মনে প্রাসাদে ফিরে এলো। তবে তার মন খারাপের কারণটা তার স্ত্রী মারা যাওয়া নয়। কারণ হচ্ছে তার শ্বাশুরী তার কাছে এলিনা কে বিয়ে দিতে কোনমতেই রাজি হননি বরং তাকে চরমভাবে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এলিনা নিজেও কিন্তু কম যায়না। সে রাজপ্রহরী ডেকে তাকে গলাধাক্কা দিয়ে প্রাসাদ থেকে বের করে দিয়েছে। সে ঐ রাজ্যের জামাই বলেই নাকি তাকে কারাগারে পুরে দেননি। কেননা যে জামাই স্ত্রীর দাফনের দিনই শালিকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে বসে সে যে একটা নারীলোভী অমানুষ তা বুঝতে কারোর ই বেগ পেতে হয়নি। অন্যথায় আসাদের শ্বাশুরী মালিহা রাণী’র নিজেরই ইচ্ছে ছিলো আসাদের হাতেই এলিনা কে তুলে দেয়ার। কেননা ঐরকম বিরাট প্রাসাদে তার মেয়ে রাণীর মতো থাকবে তার জন্য এরচে’ বড় সুখ আর কি হতে পারে। কিন্তু তাও আর হলোনা আসাদের আসল চেহারা দেখার পর। এখন আসাদ দু সপ্তাহ প্রাসাদে নিঝুম হয়ে বসে রইলো। তার শরীরে যেন একের পর এক আগুনের ফুলকি এসে পড়ছিলো। কেউ জলন্ত কয়লা দিয়ে তার অঙ্গকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছিলো। আর সে নিজেকে সামাল দিতে পারলো না। দু ভাইয়ের কেউই নেই এখন। একজন নীল দরিয়ার ওপারে আরেকজন দীল- দরিয়ার ওপারে। এই সুযোগ সে ঠিকভাবেই কাজে লাগালো। সে এতিমখানা ও মসজিদের সবাইকে কামরুর চল্লিশা উপলক্ষ্যে এক বিরাট ভোজসভায় নিমন্ত্রন করলো। যদিও মসজিদের কেউ এতে যাননি। হুজুরেরা বললেন এগুলো সম্পূর্ণ বিদাত। যদি এমনিতে লোককে খাওয়ানোর জন্য এই দাওয়াত দেয়া হতো তাহলে তারা অবশ্যই আসতো। কিন্তু এতিমখানার অসহায় ছেলেমেয়েরা রাজকীয় খাবার লোভ সামলাতে না পেরে সবাই চলে এলো। আমিও ছিলাম সেখানে। ভেবেছি আমাদের রক্ষক জমিদার তারেকুজ্জামান বিদেশে চলে গেলেও তার স্থানে আরেক ভাই রয়েছেন। এখন থেকে উনিই আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। কিন্তু আমার জানা ছিলোনা সেই লোকটি ছোট ভাইয়ের স্বভাব নয় পেয়েছে তার বড় ভাইয়ের স্বভাব। সে ছোট ভাইয়ের মতো প্রজারক্ষক না হয়ে হয়েছিল বড় ভাইয়ের মতো আরেকটি নারীভক্ষক নরপশু। সবাই যখন খেয়েদেয়ে চলে যাচ্ছিলো তখন সে সবার মধ্য থেকে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলো। আমি ও যাই নতুন সাহেবের ডাক পেয়ে। প্রথমে সে বললো তার জুতোজুড়া মুছে দিতে। সে দরকারী কাজে বাইরে বেরুবে। আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ মুছে দিলাম। পরে সে বললো তার জামা টা ইস্ত্রি করে দিতে। আমি তাও করে দিলাম। এভাবে সে আমাকে বিভিন্ন কাজ দিয়ে ব্যস্ত রেখে অন্য সবাইকে প্রাসাদ থেকে বিদায় করে দিলো। আমি তার হাতঘড়িটা এনে তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে খপ করে আমার হাতটি ধরে ফেললো!
সে বলে এতোদিন শুধু আমার ভাইয়ের মনোরঞ্জন করেছিস। এখন আমার পালা। জানিনা তোর রেণুতে কতোটা মধু আছে! আয়, আজ থেকে আমার মন আর দেহ দুটোই তোকে রাঙাতে হবে।

আসাদের কথা শুনে মনে হলো আমার পায়ের তলার মাটিগুলো যেন পাতাল অব্দি দেবে গিয়েছে, মাথাটা প্রবলভাবে চক্কর দিচ্ছে! মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাবো।

কিন্তু তখনই আমার মন বলে উঠলো প্রয়োজনে জীবন যাবে তবু ঐ শয়তানের হাতে নিজেকে সঁপে দিওনা। যত জলদি পারো পালাও এখান থেকে!
আমি তক্ষুণী ছুটে সে কামরা থেকে বের হয়ে প্রাণপনে বড় গেটের দিকে দৌঁড় দেই। শয়তানটাও হাসতে হাসতে আমার পিছু হেটে আসে। এসেই চিৎকার দিয়ে প্রধান ফটকের রক্ষীকে আদেশ দেয় ফটকের দরজা বন্ধ করে দিতে। রক্ষীটাও তাই করে।
আমি তখন চারপাশে শুধুই অন্ধকার দেখছিলাম। পালানোর মতো কোন রাস্তাই ছিলোনা আমার। তখন ঐ শয়তানটা হাসতে হাসতে এসে আমাকে তার কাঁধে করে উপরে নিয়ে যায়।কিন্তু সে তার কামরায় ঢুকার আগেই আমি তার বাম কানে এক জম্পেশ কামড় বসিয়ে দেই। সে তখন চিৎকার দিয়ে আর্তনাদ করে আমাকে ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। আমি তখন প্রাণপনে দৌড়ে ছাদে চলে আসি। এখান থেকে নিচে নামার কোন পথই নেই। প্রাসাদের গাঁ ঘেষে কোন গাছপালা কিংবা খুঁটি কিছুই নেই যে আমি সেগুলো বেয়ে নিচে নামতে পারি। ইতিমধ্যে সে পিশাচ যমের বেশে ছাদে উপরে চলে এলো। এসেই হিংস্র পশুর মতো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।।।

আমি বাঁচার জন্য প্রাণপনে চিৎকার করতে থাকি কিন্তু সে চিৎকার আবার প্রতিধ্বনি হয়ে আমার কাছেই ফিরে আসে। এক পর্যায়ে আমি আমার ধারালো নখ দিয়ে তার গলায় আচড় কেটে দিই। এতে তার গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। সে আরো রেগে গিয়ে আমার চুলের মুটি ধরে আমাকে দাঁড় করিয়ে আমার গালে কষে থাপ্পর মারে।

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর