পুরানো প্রাসাদ — শাকেরা বেগম (শিমু)

admin
  • আপডেট টাইম : আগস্ট ২৮ ২০২০, ১৯:১৩
  • 1173 বার পঠিত
পুরানো প্রাসাদ — শাকেরা বেগম (শিমু)

(তৃতীয় পর্ব)
*****
আসাদুজ্জামান তার শ্বশুরবাড়ি রাজনগর থেকে তিনমাস পর ফিরে এসেছে। এসেই সে প্রথমে গিয়ে টাকা ও স্বর্ণমুদ্রার সিন্দুকটা একবার চেক করে আসলো। এটা তার নিয়মিত স্বভাব। বাইরে থেকে এসেই সে একবার তার ভাগের টাকাগুলো হিসেব করে নেয়। কারণ তার ভয় ও সন্দেহ হয় যদি তার অবর্তমানে তার ভাইয়েরা ওগুলো মেরে দেয় সেজন্য সে তার বড় ভাই কামরুজ্জামানের চাইতেও আরো একধাপ বেশি এগিয়ে ছিল।

কামরু শুধু নারীলোভী ও মদ্যপই ছিলো, কিন্তু এই হায়ওয়ান আসাদ মদ, নারী এর পাশাপাশি প্রচন্ড অর্থলোভীও ছিলো। তাই সে বারবার তাদের জমিদার বাবাকে চাপ দিতো তাকে সিংহাসনে বসানোর জন্য। কিন্তু উনি বিচক্ষণ মানুষ তাই ওদের দু ভাইয়ের লোভ, নেশা ও দায়িত্বহীনতার দরুণ কাউকেই সিংহাসনে না বসিয়ে বসালেন তার সবার ছোট ও প্রজাদরদী, ধার্মিক ছেলে তারেউজ্জামানকে। এটা দেখে অপর দু’জনের পিত্ত জ্বলে উঠে হিংসা আর অপমানে। উনারা ছোট ছেলেকে মণিপুরের নতুন জমিদার ঘোষণা করার পর দুজনে ভিনদেশে ভ্রমণে গিয়ে সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। কেউই জানতে পারেনি উনারা বেঁচে আছেন কি নেই। যখন থেকে তারেক নতুন জমিদার হন সেই থেকেই ওরা দু’ভাই ই তারেকের উপর ক্ষেঁপে ছিলো। কয়েকবার তাকে মারার চেষ্টা করেও সুযোগের অভাবে তা পারেনি।

এখন কামরুর ছুড়ে মারা বোতলের আঘাতে তারেকউজ্জামানের মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো! তারেক আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সাথে সাথে সকল মুসল্লীরা ক্ষেঁপে উঠে কামরুজ্জামানের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

ওরে হারামির বাচ্ছা ! নিজের ভাইরে এইভাবে মারতে তোর দিল কাঁপলো না! আইজকা তোরে আমরা জানে মাইরা ফালামু- বলে ওরা দলবেঁধে কামরুজ্জামানকে মাটিতে ফেলে দিয়ে এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি-লাথি মারতে থাকে। আমি আমার ওড়না ছিড়ে উনার মাথায় পট্টি বেঁধে দেই।
পরে আমি চিৎকার দিয়ে উনাদের থামতে বলি। কারণ আমাদের জমিদার মশাইয়ের মাথায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। তাই উনাকে আগে চিকিৎসা দেয়া দরকার। আমার ডাকে তখন মসজিদ সংলগ্ন ‘শিসাহালী’ এতিমখানার চার-পাঁচজন বালক ছুটে আসে। আর মুসল্লীরা তখনো কামরুজ্জামান কে ক্রমাগত কিল-ঘুষি মেরেই চলেছে। আমি ও এতিমখানার লোকজন মিলে তারেকুজ্জামানকে এতিমখানার ভিতরে নিয়ে যাই।

নিচের তলায় পুরূষরা থাকতো। ওরা উপরে গিয়ে মহিলাদের ডেকে এনে বলে আমাদের জমিদার মশাই আহত হয়েছেন। জলদি উনার শুশ্রুশা শুরু করো। মেয়েরা তখন উনার কপাল থেকে পট্টি সরিয়ে ক্ষতস্থানে চুন-হলুদ মেখে সেখানে ভালো করে আরেকটি পট্টি লাগিয়ে দেয়। আরো কয়েকজন বালতি ভরে পানি এনে উনার মাথাটা এক চৌকোণা পলিথিনে রেখে তাতে পানির ধারা দিতে থাকে। আমার পায়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে দেখে এতিমখানার কয়েকটি মেয়ে মসজিদের সামনের ফুলবাগান থেকে গাঁদাফুল গাছের পাতা এনে তার রস নিংড়ে আমার পায়ে লাগিয়ে দেয়। এভাবে আমি ও জমিদারমশাই দু’জনেই কিছুটা সুস্থবোধ করি। ওদিকে কামরুজ্জামান মসজিদের মুসল্লীদের হাতে গণধোলাই খেয়ে তার নাক-মুখ ফেটে রক্তক্ষরণ হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মারা যায়।

যখন জমিদার মশাইয়ের কাছে তার ভাই মরার খবরটা পৌঁছালো তখন তিনি শুধু একবার ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ‘ পাঠ করলেন। আর কোন শব্দ শুনা যায়নি তার মুখে। মুসল্লীরা কিন্তু এতেও ক্ষান্ত হয়নি। ওরা কামরুজ্জামানের লাশকে মসজিদ প্রাঙ্গন থেকে সরিয়ে জমিদার প্রাসাদের সামনে নিয়ে হিন্দুদের মতো চিতার আগুন জেলে তার লাশকে সেই আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। তখন কামরু’র মড়াপুড়ার সময় এমন বিকট দুর্গন্ধ বেরুতে লাগলো যে তার মড়ার দুর্গন্ধে জমিদার- প্রাসাদ, মসজিদ ও এতিমখানার সকলেই ঘৃণায় বমি করে দেয়। শুধু দু’জন লোক ছাড়া। সে দু’জন ছিলাম আমি ও স্বয়ং জমিদার তারেকুজ্জামান।

আমি এই দৃশ্যটা বেশ তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করছিলাম। যে মানুষরূপী পিশাচ এতোদিন আমাকে তার বিনোদনের খোরাক বানিয়ে এসেছে আর আজকে অবশেষে আমার সম্ভ্রমহানি ঘটাতে চেয়েছিলো! সেই পশুর শেষ পরিণতি দেখে আমি সৃষ্টিকর্তা কে ধন্যবাদ জানাই। আর জমিদার তারেকুজ্জামান মশাই এই দৃশ্য দেখে শুধু নীরবে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলেছিলেন। আর কোনই ভাবান্তর ছিলোনা তার মধ্যে। অন্যায়ভাবে একটা মেয়েকে ভোগ করার জন্য যে বড়ভাই তার আপন সহোদরের মাথায় রক্ত ঝরাতে পারে, তার এমন অপমৃত্যুতে অধঃমুখে অশ্রুঁ বিসর্জন করা ছাড়া আর কি’বা করার আছে তার। তাকে এভাবে অশ্রুঁসিক্ত নয়নে দেখে একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো-“যে লোকটি আপনাকে মেরে রক্তার্ত করেছে তাও আপনার বানানো এই পবিত্র জায়গা ‘মসজিদে’র ভিতরে এসে!

তার মৃত্যুতেই আপনি এভাবে কাঁদছেন হুজুর!”
জমিদার মশাই তখন অশ্রুঁ মুছে বলতে লাগলেন- “হাজার হলেও উনি তো আমার আপন বড় ভাই। উনার এমন অপমৃত্যু আর বিনা গোসল ও জানাযায় তার লাশ আগুন দিয়ে পুড়ানোর এই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে আমার ভেতরটা কেউ যেন বিষাক্ত তীর মেরে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে। বেঁচে থাকলে অন্তত তিনি তওবা করার সুযোগটা পেতেন। কিন্তু এমতাবস্থায় বিনা তওবায় মারা যাওয়াটা উনার জন্য কতোটা আযাবের কারণ হয়ে দাঁড়াবে তাই ভেবে আমি দিশেহারা হয়ে কাঁদছি।

আল্লাহ যেন তার এই গোনাহগার বান্দার সব গুনাহ নিজ অনুগ্রহে ক্ষমা করে দেন। সবাই একসঙ্গে বললো-আমিন।

আমি তখনো দেখে চলেছি কিভাবে কামরুজ্জামানের দেহ পুড়ে ভষ্ম হচ্ছে। কিভাবে মঠ্ মঠ্ করে তার হাড়গুলো সব ভেঙে ভেঙে খসে পড়ছে শরীর থেকে।
এক পর্যায়ে সে পুড়ে পুরোপুরি ভষ্ম হয়ে গেলে সবাই তার মড়ার ছাঁইগুলো একটি কাপরে পুরে বেঁধে সেগুলো উত্তরদিকের নীলাঞ্জলা নদীতে ভাসিয়ে দেয়।

তবে ঘটনা কিন্তু এখানেই শেষ না। এরপরই শুরু হয় আসল রহস্যের ভয়াবহতা। যারা যারা এ কাজে অংশগ্রহন করেন তারা সবাই পরবর্তী সাতদিনের মাথায়ই ভয়ানকভাবে অপঘাতে মারা যান! কেউ কেউ মাথাহীন অবস্থায় তো কাউকে আবার পুরো শরীর দু’ফাক অবস্থায় পাওয়া যায়। কারো গলায় কালশীটে পাঁচ আঙুলের দাগ পাওয়া যায় তো কারো পুরো দেহই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। এই কয়দিনে আমি ও জমিদারমশাই দু’জনই অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম। জমিদার তারেকুজ্জামান ওদের সবার আকস্মিক ও এরকম অপঘাতে মৃত্যু হতে দেখে নিশ্চিত হলেন যে এটা সাধারণ কিছু নয়। এসব সক্রিয়ভাবে কেউ একজন করছে এবং সেই একজন যে কে সেটাও উনি ভালোভাবেই বুঝতে পারলেন! তখন তিনি জামায়া মসজিদে এক বিশাল কুরআন খতম ও দুরূদ সভার আয়োজন করেন।

যেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত বিশজনের মতো কুরআনের হাফেজ ও আলেমগণ ছিলো। তারা সবাই তিনপারা করে মোট একাধারে দু’বার করে কুরান খতম দেয়া হয়। এরপর হাফেজ, মুসল্লী ও এতিমখানার সকলে মিলে প্রায় পাঁচলক্ষ বার দুরূদ পড়ার শেষে অনেক লম্বা দোয়ার মাধ্যমে শেষ করা হয় খতম। দোয়া পড়ান স্বয়ং জমিদার তারেকুজ্জামানই। দোয়ায় এলাকার সবার নিরাপত্তার সাথে তিনি নিজের ভাইয়ের আত্মার মাগফেরাতও কামনা করেন। এরপর সেখানে আর কখনো এসব অলৌকিক দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি। হতে পারে তার ভাইকে আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন। এরপরে তিনি চলে যান সৌদি আরব। যাবার আগে এখানে তার সঙ্গের পাঁচজন মাওলানাকে রেখে যান শিক্ষাদানের জন্য। উনারা সবাই এই এতিমখানাতেই উপরের তলায় থাকতেন।
মালিনীর প্রেতাত্মা কথা বলার এক পর্যায়ে খালেদ নীরবতা ভেঙে বললো-
“তখন যদি সেই দোয়া মাহফিলের পর থেকে সব ঠিকঠাক হয়েই গিয়েছিলো তাহলে তারপর এই দেড়’শ বছরে কেন হাজার হাজার মানুষ মারা গেলো! কে মারলো তাদের?

মালিনী: সে অন্য এক রহস্য। অন্য একজন মেরেছে তাদের যদিও কতিপয় পুরূষদেরকে আমিই মেরেছি। কিন্তু অধিকাংশকে মেরেছে আর এক পিশাচ! যে কিনা কামরুজ্জামানের চাইতেও ভয়ংকর আর হিংস্র ছিলো। আর তার মৃত্যুও হয়েছিলো সেরকম ভয়ংকরভাবেই যেভাবে পরবর্তীতে সে অন্যদের হত্যা করতো।
ওরা সবাই মিলে একসাথে জানতে চাইলো- ‘কি সেই রহস্য’! আর কে সেই পিশাচ? বলোনা মালিনী বলোনা!
অতঃপর মালিনী তাদের সেই ভয়াবহ পিশাচের গোপন মৃত্যু ও ভয়ংকর নরহত্যার বীভৎস রহস্য শুনালে লাগলো

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর