আজ আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষাবর্ষ (2019)-এর আলোকে সাঁওতালী ভাষা স্বীকৃতি দিবস লিখেছেন– বিশ্বনাথ হেম্ব্রম

admin
  • আপডেট টাইম : ডিসেম্বর ২২ ২০১৯, ১১:০২
  • 1284 বার পঠিত
আজ আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষাবর্ষ (2019)-এর আলোকে সাঁওতালী ভাষা স্বীকৃতি দিবস  লিখেছেন– বিশ্বনাথ হেম্ব্রম

আজ থেকে ঠিক 3বছর আগে ‘জাতি সংঘের'(United Nations) সাধারণ অধিবেশনের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী কমিটির রেজুলেশন এ/আর ই এস /71/178 আদেশ বলে 19শে ডিসেম্বর 2016 সালে 2019 সালকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষাবর্ষ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। যা IYIL 2019 (International Year of Indigenous languages) নামে পরিচিত। এর দায়িত্ব দেওয়া হয় UNESCO কে (United Nations Education, Scientific & Cultural Organization) ।

কিন্তু কেন এই আদিবাসী ভাষাবর্ষ?
জাতি সংঘ সমীক্ষা করে দেখেছে যে, 1901 সাল থেকে 2000 সাল পর্যন্ত এই 100 বছরে প্রায় 600টি ভাষার অবলুপ্তি ঘটেছে এবং বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে মোট 2680 টি আদিবাসী ভাষা বিপদ জনক সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করছে। যে সমস্ত ভাষায় 1000 জনের কম লোকজন কথা বলে, সেই সব ভাষাকে বিপদ জনক সীমারেখার ভাষা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

তাই সারা পৃথিবী জুড়ে ভাষার বিপন্নতা, ভাষার গুরুত্ব ও ভাষার সমৃদ্ধি, ঐক্যবদ্ধতা বোঝাতে এই ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষাবর্ষ 2019’ । ভাষা শুধু মনের ভাব ও আদান প্রদানের মাধ্যম নয়। ভাষা হল শিক্ষার সোপান, জ্ঞানের ভান্ডার, বিকাশের ব্যাপ্তিও বটে। ভাষা সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। প্রত্যেকটি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষার বিলুপ্তি মানে সেই ভাষার সঙ্গে জড়িত সমাজ, সংস্কৃতি,ইতিহাস,ঐতিহ্য,কর্ম,ধর্ম সবের সলিল সমাধি ঘটা।

এই আদিবাসী ভাষা বর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের জনগণকে ভাষার পরিধি, ঐক্য, সমৃদ্ধি, যোগসূত্র ইত্যাদি সম্পর্কে জাগ্রত, সচেতন করে ভাষার সংরক্ষণ, প্রসার ও সাবলীল করাই হলো মূল লক্ষ্য।

তাই এই আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষাবর্ষ 2019 – এর আঙ্গিকে আগত এবারের 22শে ডিসেম্বর 2019 সাঁওতালী ভাষা স্বীকৃতি দিবস পালনের তাৎপর্য অনেকখানি। দীর্ঘ বৎসরের বহু লড়াই সংগ্রাম আন্দোলনের ফলস্বরুপ 2003 সালের 22শে ডিসেম্বর দিনটিতে সাঁওতালী ভাষা ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তপসিলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। একদা এই সাঁওতালী ভাষা কে ‘ঠার ভাষা’, ‘জংলী ভাষা’র ব্যঙ্গ শুনতে হয়েছে। যা আজ 22টি সংবিধান অন্তর্ভুক্ত ভাষা সমূহের একটি অন্যতম ভাষা রুপে বিরাজ করছে।

এই সাঁওতালী ভাষা বহু প্রাচীন ও সমৃদ্ধ শালী ভাষা। বহু ভারতীয় ভাষাবিদ দ্বারা তা প্রমাণিত। ভারতীয় অন্যান্য সব ভাষা গুলি সাঁওতালী ভাষার কাছে ঋণী।

সাঁওতালী ভাষার বিশেষ কিছু মৌলিকত্ব অন্যান্য ভাষা থেকে একে আলাদা করেছে। যা এই ভাষা কত সমৃদ্ধশালী তা প্রমান করে। যেমন— একটি বাঘ ছুটছে/তৗরুব-এ দৗড় আকাদা। দুটি বাঘ ছুটছে /তৗরুব কিন দৗড় আকাদা। অনেকগুলি বাঘ ছুটছে /তৗরুব ক দৗড় আকাদা।

এই ক্ষেত্রে একটি, দুটি, অনেকগুলি সংখ্যা বাচক শব্দ ব্যবহার করতে হচ্ছে কিন্তু সাঁওতালীতে নির্দিষ্ট শব্দ প্রয়োগ করেই সংখ্যা বোঝানো সম্ভব হয়। তাই ‘তৗরুব’ মানে একটি বাঘ, ‘তৗরুবকিন’ মানে দুটি বাঘ, ‘তৗরুবক’ মানে অনেকগুলি বাঘ বোঝায়। আবার পাখি বসে আছে /চেঁড়ে আব আকানায়। মানুষ বসে আছে /মানমী দুড়ুব আকানায়। গরুটি বসে আছে /ডাংরি বুরুম আকানায়। শাক তুলছে/আড়াঃ সিদ্ এদায়। পাতা তুলছে/সাকাম হেজ্ এদায়।

এক্ষেত্রে পাখি, মানুষ, গরু প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে ‘বসে আছে’ শব্দ প্রয়োগ হয়েছে কিন্তু সাঁওতালীতে দেখুন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা শব্দ প্রয়োগ হয়েছে। পাখির ক্ষেত্রে ‘আব আকানায়’, মানুষের ক্ষেত্রে ‘দুড়ুব আকানায়’ আর গরুর ক্ষেত্রে ‘বুরুম আকানায়’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সেই ভাবে শাক তুলছে, পাতা তুলছে ক্ষেত্রে ‘সিদ্’ ও ‘হেজ্’ শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে। যা সাঁওতালী ভাষা কে অন্য সব ভাষা থেকে আলাদা করেছে।

তেমনি বহু শব্দ সাঁওতালী ভাষা থেকে সংস্কৃত, বাংলা , হিন্দি ভাষা তে প্রবেশ করেছে বা মিল দেখতে পাওয়া যায়।

উদাহরণ স্বরূপ—
ক্রমান্বয়ে সাঁওতালী /সংস্কৃত /বাংলা
চাতম/ছত্রম/ছাতা,
তুলৗম/তুলম/তুলো,
সাকোম/শংখম/শাঁখা,
সুতৗম/সূত্রম/সুতো,
কাটকম/কর্কটম/কাঁকড়া,
গতম/ঘৃতম/ঘি,
অৗরশি/আরশি/আরশি,আয়না,
ইটৗ/ইস্টক/ইট,দুয়ৗর/দ্বার/দরজা,
কিরিঞ/ক্রি/ক্রয়,
কেনা,কাসকম/কার্পাসম/কার্পাস,
রহয়/রুহ/রোয়া ইত্যাদি…

সাঁওতালী ভাষার সঙ্গে পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মু মহাশয়ের নাম অতোৎপ্রতো ভাবে জড়িয়ে আছে। 1925 সালে সাঁওতালী ভাষার লেখ্যরুপ আবিষ্কার করে সাঁওতাল জাতিকে নতুন দিশার আলো দেখিয়েছেন । যা অলচিকি নামে পরিচিত।

কিন্তু আজ বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে এই সাঁওতালী ভাষায় কথা বলার লোক বিভিন্ন কারণে যেভাবে হ্রাস পাচ্ছে। যা খুব চিন্তিত বিষয়। 2011 সালের আদমসুমারী (Census) রিপোর্ট তাই বলছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা রাজ্যের পরিসংখ্যান দেখুন।

সাঁওতাল জনসংখ্যা /সাঁওতালী বলা সংখ্যা
পশ্চিমবঙ্গ
25,12,331জন 24,29,073 জন

ওড়িশা

8,94,764 জন 8,62,590 জন

বার তুলনামূলক ভাবে ঝাড়খন্ড, বিহার, ত্রিপুরা রাজ্যের চিত্র ভিন্নধর্মী। এই সব রাজ্যসমূহে সাঁওতাল জনসংখ্যা থেকে সাঁওতালী তে কথা বলার লোকজন বেশী।

সাঁওতাল জনসংখ্যা/সাঁওতালী বলা সংখ্যা
ঝাড়খন্ড
27,54,723 জন 32,69,897 জন
বিহার
4,06,076 জন 4,58,949 জন
ত্রিপুরা
2,913 জন 3,975 জন

এই সাঁওতালী ভাষা স্বীকৃতি দিবস 2019 সালে 17তম বছরে পদার্পণ করল। সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে সাঁওতাল অধুষ্যিত অঞ্চলে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে পালিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সবাই কে মনে রাখা দরকার, এই সাঁওতালী ভাষা স্বীকৃতি দিবস কে আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সাঁওতালী ভাষার ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সবাইকে অবগত করা দরকার তৎসহ সাঁওতালী ভাষা স্বীকৃতি আন্দোলনের ইতিহাসও সবাইকে জানানোর এটাই সঠিক সময়।
পরিশেষে বলব আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা বর্ষ 2019(IYIL 2019)কে সামনে রেখে আগত 17তম সাঁওতালী ভাষা স্বীকৃতি দিবস 22শে ডিসেম্বর 2019 উদযাপন সফল হোক এই কামনা রইল।

তথ্যসূত্র –
Google, Wikipedia
An Introduction to the Santal Language – Rev. J Phillips
সাঁওতালী ভাষা চর্চা ও বিকাশের ইতিহাস- পরিমল হেম্ব্রম
কৃতজ্ঞতা স্বীকার – মাননীয় মঙ্গল সরেন মহাশয়।

লেখকঃ বিশ্বনাথ হেম্ব্রম
কল্যাণী, নদীয়া।

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর